মহান গণঅভ্যুত্থান দিবস আজ। ১৯৬৯ সালের এই দিনে ঐতিহাসিক ১১ দফার ভিত্তিতে রচিত হয় মহান গণঅভ্যুত্থান। আত্মাহুতি দেন মতিউর ও রুস্তম। এর আগে ২০ জানুয়ারি ছাত্রদের মিছিলে গুলি হলে শহীদ হয়েছিলেন ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান। এ হত্যার প্রতিবাদেই ২৪ জানুয়ারি প্রদেশব্যাপী ডাকা হয়েছিল সকাল-সন্ধ্যা হরতাল। এই মহান গণঅভ্যুত্থানের বীজ রোপিত হয়েছিল ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে।

২১ জানুয়ারি ঢাকায় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম কমিটি ২২, ২৩ ও ২৪ জানুয়ারি শোক ও হরতাল পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। আসাদ হত্যার পরের ৩ দিন সরকারের নিয়ন্ত্রণ বলে কিছু ছিল না। শহর থেকে সরকারি বাহিনী অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম কমিটির শোক ও হরতাল কর্মসূচির শেষ দিনে অর্থাৎ ২৪ জানুয়ারি পুলিশ আবার বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর গুলি চালায়। এর ফলে পরিস্থিতি সরকারের এতই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় যে 'লৌহমানব' আইয়ুব শাহি তার বাকি দুই মাস আয়ুস্কালে আর কখনোই ১৪৪ ধারা জারি করতে পারেনি।

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক যে রাষ্ট্রটির গোড়াপত্তন হয়েছিল, তার প্রতি বাঙালির মোহমুক্তি ঘটে ১৯৪৮ সাল থেকেই। মহান ভাষা আন্দোলন বাঙালির জাতিসত্তাকে নতুনভাবে উজ্জীবিত করে।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বাঙালির স্বার্থের পক্ষে আপসহীন যুক্তফ্রন্ট জয়ী হলেও সে রায় মানা হয়নি। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করেন। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ, প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে বাঙালি জাতিসত্তাকে বিকশিত করার পক্ষে নিরলস প্রচেষ্টা চালানো হয়।

১৯৬২ ও ১৯৬৪ সালের শিক্ষা আন্দোলন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালিকে আবারও ঐক্যবদ্ধ করে। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা ঘোষণা করেন। ছয় দফা দাবির ভিত্তিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ দেশব্যাপী প্রচার চালায় ও একে জনপ্রিয় করে তোলে।

১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ প্রমাণ করেছিল, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও বাঙালি জাতি কত অসহায়। ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুসহ অন্য নেতাদের নামে আইয়ুব শাহি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও ছয় দফাকে সামনে নিয়ে নিরন্তর আন্দোলনের সূচনা করে। পাশাপাশি মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর অনুসারীরা এবং পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি সামরিক শাসন প্রত্যাহার ও বিভিন্ন দাবিকে কেন্দ্র করে আন্দোলন অব্যাহত রাখে।

১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি মতিউর রহমানের আত্মদানের মধ্য দিয়ে গোটা পূর্ব পাকিস্তান অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। জনগণ রাজপথে নেমে আসে। এর পেছনে ছিল ছাত্রলীগ এবং এ দেশের ছাত্রসমাজ। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আইয়ুব শাহি ক্ষমতা ত্যাগে বাধ্য হয়।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ দেশের ছাত্রসমাজ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সুনির্দিষ্টভাবে কর্মপন্থা গ্রহণ করেছিল। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান দেশকে নিয়ে যায় স্বাধীনতার পথে এবং ছাত্রসমাজ থাকে এ আন্দোলনের সামনের সারিতে।

১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ১ নম্বর অভিযুক্ত হিসেবে ফাঁসির আদেশের ঝুঁকির মুখে। তাঁকে মুক্ত করে আনে ছাত্র-জনতা। মুক্ত বিজয়ী বীর শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে ছাত্রসমাজ, ডাকসু ও ছাত্রলীগ 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পশ্চিমাদের ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহা বাঙালিকে এক দফার আন্দোলনের পথে নিয়ে যায়। সাড়ে ৭ কোটি মানুষের তখন একজনই নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অবশেষে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আসে আমাদের এই স্বাধীনতা।

আসাদের শার্ট লাঠির মাথায় বেঁধে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক মিছিলের প্রেক্ষাপটে কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, তাঁর বিখ্যাত স্বাক্ষরফলক কবিতা 'আসাদের শার্ট'। আসাদ হত্যার প্রতিক্রিয়ায় তিনি আরও একটি অমর কবিতা লিখেছিলেন, 'এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়?' হেলাল হাফিজ লিখেছিলেন, তাঁর অন্যতম বা সব থেকে জনপ্রিয় 'নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়' (এখন যৌবন যার মিছিলে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়) কবিতাটি।

আসাদ হত্যাই আমাদের দেশের ইতিহাসের সব থেকে সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ একক হত্যাকাণ্ড। এক অতি স্বল্প পরিচিত ছাত্রনেতার হত্যাজনিত স্ম্ফুলিঙ্গ গণঅভ্যুত্থানের দামানল সৃষ্টি করেছিল, যা আইয়ুবের পরিণতি অমোচনীয়ভাবে নির্ধারণ করে দিয়েছিল।

শুধু ক্ষমতাচ্যুতিই নয়, আসাদ হত্যাকাণ্ড নিমেষে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আইয়ুব খানের পুরো নাম-নিশানা, স্থাপনাও নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল।

সারাবিশ্ব আজ এক সংকট মোকাবিলা করছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে। প্রতিদিন নতুন নতুন অনিশ্চয়তা নিয়ে উঠছে ভোরের সূর্য। এমন পরিস্থিতিতে অনেকটাই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা। প্রতিদিনই বাড়ছে নিত্যপণ্যের বাজারদর। ঘাড় নিঃশ্বাস ফেলছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হচ্ছে রাজনৈতিক মাঠ। 

আগামী দিনগুলোর পথচলায় পাথেয় হোক নব্বইয়ের আন্দোলনের মূল চেতনা অসাম্প্রদায়িক, শোষণ-বৈষম্যমুক্ত একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের চেতনা। যে চেতনায় আত্মাহুতি দিয়ে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল, হয়েছিল একাত্তরের সশস্ত্র সংগ্রাম। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। 

আসুন আমরা বাংলাদেশে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করি, যাতে কাঙ্খিত গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণ করা যায়। আজকের এই দিনে মানুষের সাংবিধানিক, গণতান্ত্রিক মানবাধিকার ও ভোটাধিকার নিশ্চিত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই হোক গণঅভ্যুত্থান দিবসের অঙ্গীকার।