যুদ্ধ, সংঘাত, সংকট, মন্দা, মহামারির মতো বৈরিতার প্রভাবে বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতা চলছে; এরই মধ্যে বাংলাদেশের মানবাধিকার, গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে ১৪ জানুয়ারি ঝটিকা সফর সেরে গেলেন সাউথ এশিয়া এক্সপার্টখ্যাত দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। গুরুত্বপূর্ণ এই মার্কিন কূটনীতিক তাঁর সফরকালে বাংলাদেশের সরকার, রাজনীতিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। অনেক কথাই বলেছেন, শুনেছেন। তবে অতি আবশ্যক অনেক কথাই বলেননি তিনি, যে কথাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বলা খুব দরকার ছিল। আর সেগুলো যে বলা হয়নি সে কথাটিও কেউ বললেন না।

কূটনীতিক পর্যায়ের আনুষ্ঠানিক আলোচনায় সার্বিকভাবে রাষ্ট্র ও জনস্বার্থ-সংশ্নিষ্ট বিষয়ই গুরুত্ব পায়; যার সঙ্গে বৈশ্বিক ব্যবস্থা ও চলমান পরিস্থিতির সামঞ্জস্য থাকে। মার্কিন কূটনীতিকের এই সফরকে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিবাচক, আঞ্চলিক ও ভূরাজনৈতিক ইস্যুতে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের অধিক গুরুত্ব দেওয়ার ইঙ্গিত ইত্যাদি নানা ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করছেন অনেকেই। তবে এর অপর প্রান্তে কিছু আছে কিনা সেটি সম্পর্কে না জানতে পারলেও অন্তত প্রশ্ন তো করাই যায়।

মার্কিন এই প্রতিনিধির আলোচনায় এবং সরকারের প্রতি দেওয়া বার্তায় মূল ইস্যু ছিল সুস্পষ্ট ও নির্দিষ্ট। সফরের আগে আলোচনায় তালিকায় থাকা ইস্যুগুলো মূলত সৌজন্যমূলক দেখি-দেখছির মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। তেমন এক প্রেক্ষাপটে কিছু প্রশ্ন সামনে আসে- লু আসলে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্য কী বার্তা দিয়ে গেলেন? মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে যে বিষয়গুলোতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হলো সেগুলোতে দেশের সাধারণ মানুষের জন্য কী ছিল? সরকারের প্রতিনিধি দল তাদের দিক থেকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করল যে বিষয়ে সেখানেই বা দেশ ও মানুষের জন্য কী ছিল?

তবে এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- কোন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে এমন উচ্চপর্যায়ের কূটনীতিকের সফরের মাধ্যমে আলোচনায় আনল মার্কিন প্রশাসন? বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কী উপমহাদেশের আঞ্চলিক শান্তি ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নষ্ট করছে? তেমনটি হওয়ার কথা নয়। কারণ সেটি হলে লুর মতো একজন বিচক্ষণ কূটনীতিক নিশ্চয় মিয়ানমারে ছুটে যেতেন। কারণ সেখানকার রাজনৈতিক, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতার মতো বিষয়গুলো এই অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছে। যেখানে জান্তার হাতে গণতন্ত্রের প্রত্যক্ষ মূলোৎপাটন তো মানবতাবাদী বিশ্ব ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে প্রত্যক্ষ করেছে। যদি সেটি একান্তই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রেক্ষাপটে হয়ে থাকে তাহলে এমন অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে সরকার বা জনগণ যেহেতু মার্কিন প্রশাসনের কাছে কোনো আনুষ্ঠানিক আবেদন বা অভিযোগ জানায়নি- কাদের আহ্বানে অভিভাবকত্বের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিল যুক্তরাষ্ট্র?

সহজভাবে বললে, লুর এই সফরে যা পাওয়া গেল তা হলো- ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কারণে যেন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং এবং তাঁদের নেতাকর্মীর কার্যক্রম ও কথা বলায় কোনো সমস্যা সৃষ্টি না হয়; সেসঙ্গে ২০১৪ ও ২০১৮-এর নির্বাচনের প্রেক্ষাপটকে ইঙ্গিত করে আগামী নির্বাচন যেন সুষ্ঠু, স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য হয় সে ব্যাপারে সরকারকে বার্তা দেওয়া এবং তা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি নেওয়া; সেই প্রতিশ্রুতি সরকার রক্ষা করছে কিনা তা মনিটর করা হবে বলে জানিয়ে দেওয়া।

পক্ষান্তরে সরকারের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন ও দেশের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সাবেক ও বর্তমান প্রশাসনিক ব্যক্তির ওপর আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়টি। এই নিষেধাজ্ঞা রাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর নয়। শুধু একটি নিরাপত্তারক্ষা বাহিনীর একটি বিশেষ শাখা ও তাঁর কয়েকজন শীর্ষ ব্যক্তির ওপর। এর বাইরে যে বিষয়গুলো নিয়ে 'গুরুত্বের সঙ্গে' আলোচনা হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে সেগুলো যে নিছক সৌজন্য এবং মূল ইস্যুগুলোকে একটি আবরণে রাখার প্রয়াস তা বুঝে নিতে কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। কারণ, এই বিবিধ তালিকার ইস্যুগুলো নিয়ে দু'পক্ষের আলোচনায় নতুন কোনো কিছুই ছিল না।

লুর কথায় ঠিক সেই বিষয়গুলোই উঠে এসেছে যেগুলো এই মুহূর্তে দেশের বিশেষ একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা হিসেবে সামনে আনা হয়েছে। এটা কাকতালীয় কিনা তা অবশ্য বলা কঠিন। তবে এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের পাশাপাশি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোরও যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভূমিকা পালনের ব্যাপার আছে, তিনি সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেননি।

লু বিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সহিংসতা সৃষ্টি না করার কথা বলে প্রশাসনিক আচরণের প্রতি দৃষ্টিপাত করেছেন। অথচ আজকের এই বিরোধী রাজনৈতিক গোষ্ঠীটি আন্দোলনের নামে এক সময় গণপরিবহনসহ বিভিন্ন যানবাহনে আগুন দিয়ে জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে মারা, ভাঙচুর ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্টের যে নজিরবিহীন সহিংসতা চালিয়েছিল সেগুলো সামনে এনে ভবিষ্যতে যেন তেমন কিছু না হয় সে ব্যাপারে কোনো উপদেশ দেননি।

সব রাজনৈতিক দলের রাজনীতি করার সমান অধিকারের কথা বলেছেন লু। কিন্তু এই অধিকার বলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধবাদী ও মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা পরিচালনায় প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত গোষ্ঠী এবং তাঁদের মতাদর্শের রাজনৈতিক শক্তি; জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদের উত্থানে সক্রিয় মদদদাতা রাজনৈতিক ব্যক্তি ও তাঁদের অনুসারী এবং আশ্রয়দাতাদের বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনধিকার চর্চার অধিকার আছে কিনা সে ব্যাপারে কোনো দিকনির্দেশনা ডোনাল্ড লুর কাছে পাওয়া যায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র কি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এমন কোনো গোষ্ঠীর সক্রিয় অংশগ্রহণ সমর্থন করবে বা করে? জনাব লুর এমন বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের প্রতিনিধিরা কেন এই অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তুলে ধরেননি? ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের প্রত্যক্ষ মদদে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ও তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের ওপর যে প্রাণঘাতী গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল- এ দেশে তেমন সহিংসতা হলে যুক্তরাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের বার্তা কেন দেয়নি?

বিগত সময়ের বিতর্কিত নির্বাচনগুলোর তথ্য তুলে ধরে আগামী নির্বাচন যেন কোনো দল বা গোষ্ঠীর স্বার্থে নয় বরং গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিকভাবে ভোটের প্রকৃত মালিক এ দেশের জনগণের নির্বাচন হয় সে ব্যাপারে লু যে বার্তা দিয়েছেন সেটিকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানায় বাংলাদেশের মানুষ। তবে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল- দলমত নির্বিশেষে এ দেশের জনগণের সর্বোচ্চ স্বার্থ বিবেচনায় বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিনিধির মাধ্যমে এসব প্রেক্ষাপট সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরে বাংলাদেশে যেন জনভোগান্তির রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি বন্ধ করা হয় সে ব্যাপারে কঠোর বার্তা দেবেন।

দেশের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ডোনাল্ড লুর কাছ থেকে এই মুহূর্তে রোহিঙ্গা সংকট এবং এ শরণার্থী গোষ্ঠীর সদস্যদের হাত ধরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিনষ্টের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানবিক বিপর্যয় ও জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার বিষয়েও কোনো বার্তা পাওয়া যায়নি। সীমান্তবর্তী এলাকায় মিয়ানমারের জান্তা শাসকের উস্কানি এবং সংঘর্ষ ও সহিংসতা সৃষ্টির মাধ্যমে সেখানকার স্থানীয় বাংলাদেশি নাগরিকদের নিরাপত্তা নষ্টের ব্যাপারেও তিনি কিছু বলেননি। যা এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি সবচেয়ে বড় বাহ্যিক হুমকি হিসেবে বিবেচিত। অবশ্য নিজেরাই যদি এসব বিষয় আলোচনায় না আনি তারই দায় কী? এ বিষয়ে সরকারের প্রতিনিধি দল জোরালো ভূমিকা কেন রাখল না তা বোঝা গেল না। গুরুত্বপূর্ণ এই মার্কিন কূটনীতিক বাংলাদেশের প্রতি যে সহায়ক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করেছেন এই ইস্যুটি জোরদারভাবে তুলে ধরা হলে হয়তো তাঁর দিক থেকে বাংলাদেশ ইতিবাচক এমন কোনো বার্তা পেত যা যে কারও কাছ থেকে পাওয়া সম্ভব নয়।

বিষয় : মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি

মন্তব্য করুন