
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৫২ বছর। আজও অসংখ্য আইনকানুন অসংগতিপূর্ণ। তেমনি একটি আইন 'সন্তানের অভিভাবকত্ব'। বাংলাদেশের আইন সন্তানের সার্টিফায়েড অভিভাবক হিসেবে শুধু বাবাকে স্বীকৃতি দিয়ে আসছে আর মাকে জিম্মাদার বলছে। যে মা সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন, সাধ্যমতো যত্নে লালনপালন করেন, সেই মা জিম্মাদার! এর চেয়ে বড় আইনি প্রহসন আর কী হতে পারে! ধিক্কার জানাতেই হয় এমন প্রহসনমূলক আইনকে। সন্তানের বৈধ অভিভাবকত্ব নিয়ে প্রতিদিন হাজারও ঘটনা ঘটে চলেছে। বিশেষ করে বিয়েবিচ্ছেদের পর এ নিয়ে জটিলতার শেষ নেই। দেশের আদালতপাড়ায় এ নিয়ে মামলা মোকদ্দমারও শেষ নেই। ২০০৭ সালে ঠাকুরগাঁওয়ে একটি ঘটনা ঘটে। সে বছরের এপ্রিল মাসে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আগে শিক্ষার্থী তথ্য ফরমে অত্যাবশ্যকীয়ভাবে বাবার নাম পূরণ করতে না পারায় ঠাকুরগাঁওয়ের এক কিশোরীকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের প্রবেশপত্র দিতে অস্বীকৃতি জানায় রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড। উল্লেখ্য, মা ও সন্তানকে কোনোরূপ স্বীকৃতি না দিয়ে বাবার চলে যাওয়ার পর ওই কিশোরী তার মায়ের একার আদর-স্নেহে বড় হচ্ছিল। পরে এ ঘটনার যথাযথ অনুসন্ধানের ওপর প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এবং সন্তানের অভিভাবক হিসেবে মায়ের স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার দাবিতে ২০০৯ সালের ২ আগস্ট তিনটি মানবাধিকার সংগঠন- বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ও নারীপক্ষ যৌথভাবে জনস্বার্থে রিট করে। সেই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে বছরের পর বছর রিটকারীরা আদালতের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে গত ২৪ জানুয়ারি বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী রায় ঘোষণা করেন। এখন থেকে এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষাসহ সব ফরম পূরণের ক্ষেত্রে সন্তানের অভিভাবক হিসেবে মাকেও স্বীকৃতি দিয়ে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। জেনারেশনের পর জেনারেশন ভোগার পর দেরি হলেও এমন রায় যুগান্তকারী, ঐতিহাসিক এবং দুঃসাহসী। আমরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো মায়ের সন্তান। আবার প্রাপ্তবয়স্করা সন্তানের পিতা-মাতা। খোলা চোখে যদি দেখা যায়, সন্তানের জন্য মায়ের ভূমিকা ব্যাপক। গর্ভে ধারণ, জন্মদান, লালনপালন এক বিরাট কর্মযজ্ঞ। এই কর্মযজ্ঞের প্রধান ভূমিকাতেই থাকেন একজন মা। বাবার ভূমিকা বা ত্যাগকেও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। তবে আমার কাছে বাবাকে মূল ভূমিকার মনে হয় না। আমি বলতে চাই, বাবা হচ্ছেন সহায়ক ভূমিকা পালনকারী। এরপরও আমাদের সমাজে অভিভাবকত্বের দিক দিয়ে বাবা এগিয়ে আছেন দীর্ঘদিন ধরে। দুঃখজনকভাবে মায়ের অভিভাবকত্বের স্বীকৃতি নেই।
আমি নিজে একটি সন্তানের বাবা হিসেবে কাছ থেকে দেখছি- আমার সন্তান বেড়ে ওঠার পেছনে তার মায়ের ভূমিকা কতটা জোরালো। গর্ভধারণ, জন্মদান, লালনপালন, পড়াশোনায় ভালো করা, অসুখ-বিসুখ হলে বিনিদ্র রজনী সেবা-যত্ন, ভালোমন্দ দেখভাল- সব কিছুতেই মায়ের ভূমিকা জোরালো। বাবা হিসেবে আমি কী করি? আমি এসব কর্মের সহায়ক ভূমিকা পালন করি মাত্র। এমনও হয়েছে, অনেক সময় ছোটবেলায় ঠান্ডাজনিত অসুস্থ হলে আমার ছেলেটি সারারাত ঘুমাতে পারত না। সেই ছেলেকে কোলে নিয়ে সারারাত জেগে থাকতে দেখেছি ওর মাকে। আমি কিন্তু পাশেই শুয়ে একটু হলেও ঘুমিয়েছি। আবার খুব সমস্যা মনে হলে আরেক বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়েছি। তেমনিভাবে আমি নিজেও এক মায়ের সন্তান। আমার নিজের জীবনেও দেখেছি, অসুখ-বিসুখ কিংবা যে কোনো সংকটে মা সবার আগে সোচ্চার হয়েছেন, সবচেয়ে বেশি অস্থিরতায় ভুগেছেন, বিনিদ্র রজনী পার করেছেন।
ঠাকুরগাঁওয়ের যে কিশোরীর অভিভাবক সংকটের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আদালতে রিট হয়েছিল এবং যুগান্তকারী রায় এলো, সেই কিশোরীর জীবনেও এক দায়িত্বহীন বাবার গল্প আছে। পত্রপত্রিকা মারফত যেটি জানা যায়, জন্মের পর সেই কিশোরীর মা ও শিশুসন্তানকে কোনোরূপ স্বীকৃতি না দিয়ে বাবা তাঁদের পরিত্যক্ত করে ফেলে চলে যায়। এরপর ওই কিশোরী তার মায়ের একার আদর-স্নেহে বড় হয়। এমন নির্মম ঘটনার পরও আমাদের সমাজ, আমাদের আইন এক প্রকার জোরপূর্বক অভিভাবক হিসেবে সেই বাবার নাম লিখতে বাধ্য করছিল। কিন্তু সেই কিশোরী এবং তার মায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ সেই নিষ্ঠুর বাবার নাম লেখেননি। এই না লেখার যুদ্ধেরই আজ জয় হলো।
আরেকটি নির্মমতা আছে আমাদের সমাজে; পতিতালয়ে যে শিশুটির জন্ম হয় কিংবা সামাজিকভাবে অস্বীকৃত উপায়ে সন্তান জন্মদানের পর বাবা-মা রাস্তায় ফেলে যায় যে শিশুটিকে, সেই শিশুটি জানে না কে তার বাবা-মা। এই রায়ের মাধ্যমে সেটিও স্বীকৃত হয়েছে।
আমরা দিন দিন সভ্য হচ্ছি ঠিকই, কিন্তু নানা আইনি এবং সামাজিক অসভ্যতা আমাদের এখনও আঁকড়ে ধরে আছে। তেমনি মানুষের অভিভাবক নির্ধারণী বিষয়টিও ছিল এক কালো অধ্যায়। খেয়াল করলে দেখা যায়, এমন আরও নানা বিষয়ে কালাকানুন এখনও সময়োপযোগী নয়। জটিলতা পরিহার করে মানুষের জীবনকে সহজ করতে সব অন্ধকার আইনকানুন রদ হবে- সেটিই প্রত্যাশা। এই রায় অন্ধকার দূর করার পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হোক।
সাজ্জাদ কাদির :কলামিস্ট, তথ্যচিত্র নির্মাতা
মন্তব্য করুন