
বর্তমানে ঢাকায় সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বায়ুদূষণ। চলতি বছরের শুরু থেকেই বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে উঠে এসেছে আমাদের রাজধানী। গত কয়েক বছর ধরে দিল্লির দখলে থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে তা ছিনিয়ে নিয়েছে ঢাকা। নিঃশ্বাসের সঙ্গে প্রতিনিয়ত দূষিত এ বায়ু আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে। তৈরি করছে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি। এটি রাজধানীবাসীকে ঠেলে দিচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি রোগ-ব্যাধির দিকে।
স্বল্পোন্নত থেকে মধ্যম আয়ের দেশের কাছাকাছি পৌঁছেছে বাংলাদেশ। প্রতি বছর মাথাপিছু আয় বাড়ছে। অর্থনীতির আকারও ক্রমবর্ধমান। তবে অনুতাপের বিষয়, এগুলোর সঙ্গে দিন দিন নাগরিক অধিকারগুলো বিলিন হয়ে যাচ্ছে। সড়ক আছে তো ফুটপাত নেই, দখল হয়ে গেছে অলিগলি, অপর্যাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিশুদের পার্ক থেকে খেলার মাঠ পর্যন্ত সবকিছুই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যেতে বসেছে। এমন সব নেতিবাচক পরিস্থিতির মধ্যে ঢাকায় নির্মল বাতাসে শ্বাস নিতে চাওয়া বিলাসিতা মনে হওয়াটা স্বাভাবিক।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার সারাবিশ্বের বায়ুর মান লাইভ আপডেট দেয়। ওই সংস্থার ওয়েবসাইটে বিশ্বের ১০০ দেশের মধ্যে ঢাকার নাম ১০ জানুয়ারি থেকে প্রায় প্রতিদিনই দিনের কোনো না কোনো সময় শীর্ষে উঠে এসেছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত সমকালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানীতে দূষণ নির্মূলের দায়িত্ব থাকা সংস্থাগুলো কর্ম সারছে পানি ছিটিয়ে আর সভা-সেমিনার গলা ফাটিয়ে। রাজধানীর সবখানেই উড়ছে ধুলা। সকাল, বিকেল কিংবা রাত- কোনো সময়ই এই দুঃসহ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি নেই। ধুলা আর ধোঁয়াকে সঙ্গী করেই ছুটছে নগরবাসী। অথচ হাইকোর্ট বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে যে ৯ নির্দেশনা দিয়েছিলেন, এর মধ্যে শুধু পানি ছিটানো কাজই মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে। উল্টো সরকারি সংস্থাই বাড়াচ্ছে দূষণ।
গত মে মাসে বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেট-এ প্রকাশিত 'গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ' শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু পরিবেশ দূষণের কারণেই ২০১৯ সালে বিশ্বজুড়ে ৯০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে মারা গেছে দুই লাখের বেশি। দূষণে মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ুদূষণের কারণে শুধু ঢাকায় বছরে ১০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।
কয়েক বছর ধরেই রাজধানীতে বায়ুদূষণ মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে। বর্তমানে এটি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, শরীরের পাশাপাশি মানসিক অবস্থাকেও বিপর্যস্ত করে তুলছে। এ জন্য বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় প্রতি বছর অবনমন হচ্ছে ঢাকার অবস্থান। বসবাসযোগ্যতা ও নাগরিক সুবিধাগত দিক থেকে বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর অবস্থানবিষয়ক জরিপকারী প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) প্রকাশিত বিশ্বের বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় ২০২১-এ অবসবাসযোগ্য শহরের পর্যায়ে নেমে গেছে রাজধানী শহরটি। ঢাকাকে অবসবাসযোগ্য শহরে নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে বায়ুদূষণ।
ঢাকায় বসবাসকারী অনেকেই অ্যাজমা, স্ট্রোক ও শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বায়ুদূষণের বেশি শিকার হচ্ছে নারী ও শিশুরা।
বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, বায়ুদূষণের ফলে বাংলাদেশের জিডিপি কমছে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। অথচ হাইকোর্টের নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন করলেই ঢাকার দূষণ আজ অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে থাকত। এখানে দূষণের প্রধান কারণ হলো- যানবাহনের ধোঁয়া, অবকাঠামো নির্মাণ ও মেরামতের কারণে সৃষ্ট ধুলা এবং ইটভাটা ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির ধোঁয়া। এসব দূষণ নিয়ন্ত্রণে আইন-বিধি সবই রয়েছে। নেই কেবল বাস্তবায়ন। প্রতিটি মূল সড়কে দু'বেলা পানি ছিটিয়েও ধুলা ওড়া ঠেকানো যায়। এর সঙ্গে নির্মাণকাজে বিধি মানার ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা আরোপের মাধ্যমে বায়ুদূষণ অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। রাজধানীর অভিভাবক সংস্থাগুলোর সমন্বয় এবং সদিচ্ছাই পারে ভয়ংকর এ দূষণ থেকে কিছুটা মুক্তি দিতে। সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট, তারা একে অপরের বিরুদ্ধে দায় চাপাতেই যেন বেশি ব্যস্ত। কাজ বলতে শুধু প্রকল্পের পর প্রকল্প।
পরিবেশ অধিদপ্তর গত ১২ বছরে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু বড় প্রকল্প হাতে নেয়। এত প্রকল্পেও বায়ুর মান ভালো হয়নি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় প্রায় ৩০ কোটি টাকায় ২০টি সড়ক ঝাড়ু দেওয়ার যন্ত্র (রোড সুইপার) কিনে ২০২১ সালের শুরুর দিকে। সেই যন্ত্র অকার্যকর প্রমাণিত হওয়ায় এখন বসিয়ে রাখা হয়েছে। প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার এমন প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দূষণ থেকে মুক্তি মিলছে না নগরবাসীর। রাজধানীর চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ইটভাটাগুলোয় প্রতিদিন ব্যাপকহারে কয়লা পোড়ানো হচ্ছে। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই চলছে সেগুলোর কার্যক্রম। অথচ পরিবেশ আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা গেলেই ইটভাটার কালো ধোঁয়ার প্রভাব কমে যেত।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এখন ঢাকাকে নতুন করে বনায়নের আওতায় আনা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এখনও যেটুকু ফাঁকা জায়গাগুলো রয়েছে, সেগুলোয় গাছ লাগাতে পারলে এখানকার পরিবেশ কিছুটা হলেও উন্নত হতো। এ ক্ষেত্রেও প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। ঢাকার ঘনবসতিও দূষণ বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। অধিক জনসংখ্যার চাপ কমাতে রাজধানীকে বিকেন্দ্রীকরণের বিকল্প নেই। প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক মানুষ ঢাকায় আসছে জীবন-জীবিকা কিংবা পড়ালেখার জন্য। অফিস, ব্যাংক, পোশাক কারখানা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক কিছু ঢাকামুখী হওয়ায় এ দশা। ঢাকাবাসীকে বাঁচাতে তাই এ শহরের দ্রুত সংস্কার জরুরি।
মন্তব্য করুন