
দিন ছিল ঝকমকে। রাত্রি চকচকে। আকাশে ঝলমলে চাঁদ। বঙ্গীয় মাঘীপূর্ণিমা। ইউরোপে মাঘ বলে কিছু নেই। মাঘীপূর্ণিমাও নয়।
ডিসেম্বরে হাড় ফাটানো শীত, বাঘের কামঋতু। জানুয়ারি মাসেও। ইউরোপের বনবাদাড়ে বাঘ নেই। দ্রষ্টব্য চিড়িয়াখানায়। খাঁচাবন্দি। জিম করবেট নয়; অন্য কোনো সাদা বিলেতির লেখায় পড়েছিলুম, 'বাঘ যদি দেখতে হয় সুন্দরবনে যাও। রয়েল বেঙ্গল টাইগার কাকে বলে!' লক্ষণীয়, শব্দটি 'রয়াল'। রাজকীয়। চেহারায়, গা-গতরে।
গত শতকের নব্বই দশকে ইউরোপের চার-পাঁচজন বন্ধু-বন্ধুনি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে গিয়েছিলুম, ক্যানিং থেকে ট্যুরিস্ট লঞ্চে। দুই দিন থেকেও বাঘ দেখিনি। সারেং বললেন, 'লঞ্চের আওয়াজ শুনলেই বাঘ গা-ঢাকা দেয়। মেছোবাঘের পদচ্ছাপও দেখছি নেই।'
বললুম, নদীতীরে কয়েকটি পদচ্ছাপ দেখছি।
সারেংমানুষের। মধু সংগ্রহ করতে গিয়েছিল।
অপূর্ণ বাসনায় ব্যাজার মুখে ফিরলুম। কলকাতার চিড়িয়াখানাতেও বাঘের পদচিহ্ন নেই।
কলকাতারই এক ফাজিল লেখকের রসিকতা, 'কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের বনজঙ্গলে ইদানীং বিস্তর বাঘ ভ্রাম্যমাণ।
শান্তিনিকেতনের শ্রী নিকেতনের শালবনে দুই বাঘ মুখোমুখি। পরস্পর আক্রমণে উদ্যত। তার আগে কুশল বিনিময়। প্রশ্ন :'ভাই, তুমিও কি বাংলায় পড়েছ?'
গল্পের শানেনজুল :দু'জনেই বাঘের ছালে সজ্জিত। বাংলায় পড়ে চাকরি না পেয়ে বাঘ সেজে বনে বনে। গুলি না করে কেউ যদি এটা-ওটা খেতে দেয়। বেকারের ভয়াবহ চিত্র।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হই। খায়েশ ছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের। আন্তর্জাতিক রাজনীতির পাঠ। নেহাল বন্ধু। প্রায়ই ওঁর আস্তানায়। নেহালের বাপ ডক্টর আহমদ শরীফ। এক সন্ধ্যায় ধমক :'তোমার মতলব নাকি নাজমুল করিমের খোঁয়াড়ে ঢুঁ মারা? তোমার দুই অগ্রজ, ভাবি (রশীদ হায়দারের স্ত্রী আনিসা) আমাদের গোয়ালে জাবর কেটেছে। কাল দুপুরে দেখা করবে।'
বিভাগে গেলুম। বললেন, 'ভর্তি হয়েছ। রেজিস্ট্রারের কাছে যাও।' ফরম পূরণ করলুম না, স্বাক্ষরও করিনি। ভর্তি হয়েছি? মৌখিক পরীক্ষা ছাড়াই?
নীলিমা ইব্রাহিম, রফিকুল ইসলাম, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বললেন :'ট্র্যাডিশন'।
সৈয়দ আকরম হোসেন খুশি কি অখুশি বোঝা দুস্কর : 'বাংলায় ভর্তি হলে?'
মাস্টারকুলে দু'জনকে পছন্দ। সৈয়দ আকরম হোসেন। সন্জীদা খাতুন। ক্লাসটদ্মাস করি না। ছাত্র ইউনিয়নে ব্যস্ত। ছাত্র থাকাকালীনই দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক।
সৈয়দ আকরম হোসেনকে একটি কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করি। আকরমের করকমলে দেওয়া হয়নি।
দিল্লির জেএনইউর (জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়) দুটি বক্তৃতায় (বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি এবং বাংলা বিভাগে কী ছাইভস্ম লিখেছি, পাঠ্য) বাংলাদেশের সাহিত্য বিষয়ে অতিকথন (দেশকে স্মরণ)। পুনে বিশ্ববিদ্যালয়েও দুটি বক্তৃতা। কথায়-কথায়, বাংলাদেশ। নস্টালজিয়া।
মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়েও। অবশ্যই সাহিত্য, বাংলাদেশ-ভারতীয় আন্তর্জাতিক সাহিত্য।
কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি বক্তৃতায়, বিষয় :'আমার কবিতার ভাবনা'।
একটি বক্তৃতায় অগ্রজ মাকিদ হায়দার, অগ্রজা ফরিদা হায়দার উপস্থিত।
ব্যস্ততা, সময়ের অভাবে বিশ্বভারতী, বর্ধমান, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনকি কলকাতা বইমেলায় বকবকানি বাদ দিই। দিলেও ১ ফেব্রুয়ারি কলকাতা বইমেলায় (কলিকাতা পুস্তক মেলা) হাজির। ঘণ্টাখানেক।
অনুষ্ঠানের সম্পাদক অনিল আচার্য বললেন, 'চলো বাংলাদেশ ঘুরে আসি।' বাংলাদেশ মানে মেলায় বাংলাদেশের স্টল। একটি আলাদা অঙ্গন।
সঙ্গে অনুজ জাহিদ। শর্ত- কোথাও পরিচয় দেবে না।
ঘুরে ঘুরে বাংলাদেশ দেখলুম। বাংলাদেশের বইয়ের স্টল। অধিকাংশই অচেনা লেখক। হোক। বাংলাদেশে এত প্রকাশক, জানতুম না। এও অজানা, বিস্তর লেখক। লেখকের নাম।
আম্মুমণি ক্ষম (ক্ষমা :শাওন্তী হায়দার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে অ্যাসোসিয়েটেড প্রফেসর) বললেন :'আমরাও সব লেখকের নাম জানিনে।' অনুজ তপনের ছেলে তন্ময়, অনুজা এলিজারও কন্যা সুকন্যার কথা :'বাংলাদেশে এখন এত লেখক, নামও জানি না। না জানলেও নতুন লেখক আনাচে-কানাচে, নিশ্চয় বাহবা দেবে। তোমরা বুড়ো। তোমরা অপাঠ্য।'
মানি।
কলকাতার বইমেলায় বাংলাদেশকে কাছে পাই। পরমানন্দ। এক চক্কর বাংলাদেশ।
মনমননে বাংলাদেশ। ঘরে আসি। দেখতে পাই বাংলাদেশের চিত্র। চরিত্র।
এই দেখায় নানা ভেজালও। ভেজালের নানা চিত্রে বাংলাদেশ স্বরূপে।
স্বরূপচিত্রে ঘুরে এলুম বাংলাদেশ, নানা বর্তিকায়। হোম, সুইট হোম।
দাউদ হায়দার: কবি
মন্তব্য করুন