- চতুরঙ্গ
- অধিকার আদায়ের সংগ্রাম
অধিকার আদায়ের সংগ্রাম

বৈশ্বিক নারী আন্দোলনের মতোই বাংলাদেশের নারী আন্দোলনও সরলরৈখিক নয়। তার আছে নানান বাঁক। সাফল্য-ব্যর্থতার ইতিহাস। সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছানোর হাতছানি সত্ত্বেও আবার পিছলে পড়া। অনেক কষ্টার্জিত সাফল্য আর অব্যাহত চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়েই এগিয়ে চলেছে নারীর অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। বিশিষ্টজনদের মতে, নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি অব্যাহত বহুমাত্রিক সহিংসতা, নারীর অপ্রতুল প্রতিনিধিত্ব, সম্পদ-সম্পত্তিতে অধিকারহীনতা, নারীর প্রতি সংবেদনশীলতার অভাব, পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের ক্ষেত্রে পিছু হটা এবং দায়বদ্ধতার অভাবই এ সংগ্রামের পথে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। তবে এসব প্রতিবন্ধকতা ঠেলে নারী আরও এগিয়ে যাবেন– ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে সামনে রেখে এমনটা প্রত্যাশা করেছেন তাঁরা। গ্রন্থনা সাজিদা ইসলাম পারুল
শক্তিশালী নারী আন্দোলনের বিকল্প নেই
মালেকা বানু
নারীমুক্তি, নারী-পুরুষে সমতা এবং নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতীয় ও বৈশ্বিক আন্দোলনের পরম্পরায় বাংলাদেশের নারী আন্দোলন সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের জন্ম। বৈশ্বিক নারী আন্দোলনের মতোই বাংলাদেশের নারী আন্দোলনও জাতীয় মুক্তির আন্দোলন, গণতন্ত্রের আন্দোলন, মানবাধিকারের আন্দোলন, শান্তির আন্দোলন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে একসূত্রে গাথা। এসব আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সারথিদের নিয়েই ১৯৭০ সালের ৪ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের জন্ম। নারীর প্রতি সহিংসতাকে নারীর উন্নয়নের পথে, নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অন্যতম বাধা হিসেবে সংগঠন চিহ্নিত করে। দেশ্যব্যাপী তৃণমূল পর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ পারিবারিক নির্যাতন, যৌতুক, বাল্যবিয়ে, বহুবিয়ে, আইনবহির্ভূত তালাক প্রদান, ধর্মীয় বা সামাজিক সালিশের মাধ্যমে ফতোয়া প্রদান– এ সবকিছুকে নারীর প্রতি সহিংসতা হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তা প্রতিরোধে বহুমাত্রিক পদ্ধতিতে কার্যক্রম পরিচালনা করে। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে নারী আন্দোলনের প্রাপ্তি উল্লেখযোগ্য হলেও চ্যালেঞ্জ আরও বেশি। তাই বিশ্ব নারী আন্দোলন, জাতীয় নারী আন্দোলন নতুন নতুন পথ ও কৌশল খুঁজছে কীভাবে সবাইকে নিয়ে সবার জন্য উন্নয়ন ও সমতার পথে অগ্রসর হওয়া যায়। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদও এই পথের সন্ধানে। একটি সমতাপূর্ণ মানবিক বিশ্ব গড়ে তুলতে শক্তিশালী নারী আন্দোলনের বিকল্প নেই।
সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
আইন সংস্কার আন্দোলন জরুরি
অ্যাডভোকেট সালমা আলী
বাংলাদেশের সংবিধানে সবার জন্য সমতার কথা বলা থাকলেও পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫-এ দেখা যায় ভিন্ন কথা। এখনও ধর্মীয় আইনের কারণে সম্পদের উত্তরাধিকার যুগের পর যুগ ধরে পুরুষের হাতে চলে যাচ্ছে। যেটা নারীর পক্ষে যুদ্ধ করেও সমাধান সম্ভব নয়। আইন সংশোধন করে নারীকে সমভাবে সম্পদের উত্তরাধিকার করা জরুরি। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আমরা যতই নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলি, বাস্তবে তা ভিন্ন। সহিংসতার ঘটনাও দিন দিন বাড়ছে। এর অন্যতম কারণ বিচারের দীর্ঘসূত্রতা। বিচার বিলম্বের কারণে বেশিরভাগ মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত ও সাক্ষী হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে অধিকাংশ মামলার আসামিই খালাস পেয়ে যাচ্ছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলায় মাত্র ৩ শতাংশ আসামি সাজা পাচ্ছে। আবার বিচার চলাকালে আপস-মীমাংসার পথও বেছে নিচ্ছেন অনেকেই। বিচার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়ানো হলেও তা মামলার তুলনায় পর্যাপ্ত নয়। আবার যেখানে ট্রাইব্যুনাল হওয়ার কথা, সেখানে না হয়ে অন্যত্র হচ্ছে। আবার কখনও কখনও নারীদের মধ্যেও পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব দেখা যায়। ‘সিঙ্গেল মাদার’ বিষয়টি সামনে এলে নারীরাই কিন্তু বাধা দেন। তাই লিঙ্গসমতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্জনগুলো ধরে রাখার জন্য যেভাবে কাজ করা দরকার, তাও হচ্ছে না। সবকিছুর ঊর্ধ্বে গণতন্ত্র। তাই গণতন্ত্র টেকসই না হলে কোনো কিছু করাই সম্ভব নয়।
সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি
প্রজনন স্বাস্থ্যসেবাও নারীর অধিকার
মনজুন নাহার
নারীরা যে শুধু শারীরিক ও যৌন সহিংসতার শিকার হচ্ছেন তা নয়, পাশাপাশি মানসিক, আবেগিক সহিংসতারও শিকার হচ্ছেন নিয়মিতভাবে। বিশ্বে প্রতি তিনজন নারীর একজনকে শারীরিক অথবা যৌন সহিংসতার শিকার হতে হয়েছে। এ ছাড়া মোট ৩৫ শতাংশ নারী জীবনের কোনো না কোনো সময় তাঁর নিকটতম সঙ্গীর দ্বারা সহিংসতার শিকার হয়েছেন। প্রজনন স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও নারীর প্রতি বৈষম্য রয়েছে। একদিকে পরিবার পরিকল্পনার বোঝা যেমন নারীর ঘাড়ে, অন্যদিকে অনেক ক্ষেত্রে এ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা নারীর নেই। স্বাধীনতা না থাকায় অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণেও নারীর স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়। বাল্যবিয়ে, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণসহ সিদ্ধান্ত না নিতে পারার মূলে রয়েছে জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা। আবার অনেক পরিবারে ছেলেসন্তানের প্রত্যাশা একজন নারীকে বারবার গর্ভধারণে বাধ্য করে। যার ফলাফল উচ্চ মাতৃমৃত্যু। প্রজনন স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে এই যে নারীর অধিকারহীনতা, এর অন্যতম কারণ তথ্য না থাকা– প্রজনন স্বাস্থ্য বা কোনো ধরনের বিপর্যয় ঘটলে কী করা উচিত। এবার নারী দিবসের প্রতিপাদ্য করা হয়েছে– ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন’। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তথ্য সরবরাহ করা অতি জরুরি। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ বলছি, তাই বাংলাদেশের প্রত্যেক নারীই যেন ডিজিটালভাবে তথ্যসেবা পান। একই সঙ্গে যেন নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা হয়।
লিড অ্যাডভোকেসি, মেরি স্টোপস বাংলাদেশ
বৃত্তের বাইরে আসার সময়
শামীমা আক্তার
করপোরেট খাত বা বৃহত্তর ব্যবসায়িক সংগঠনে নারীদের পদচারণা প্রতিদিন বেড়ে চলেছে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এখন পরিষ্কারভাবে অনুধাবন করতে পারে– প্রতিষ্ঠানে বৈচিত্র্য ব্যবসার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণ হিসেবে ইউনিলিভারের কথা বলা যেতে পারে। ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠানটিতে ১০ শতাংশ নারী ছিল। তবে সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও ধারাবাহিক কাজের মাধ্যমে নারীর অংশগ্রহণ ৪৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। একই সঙ্গে আমাদের প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ৫০ শতাংশ নারীর নেতৃত্ব রয়েছে। তবে এটাও স্বীকার করতে হবে, এই চিত্র সব জায়গায় এক নয়। ইউনিলিভার নারীর অংশগ্রহণে অনেকখানি এগিয়ে রয়েছে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে সংখ্যাটি এখনও ২০ শতাংশের আশপাশে। এ সংখ্যা থেকেই বোঝা যায়, করপোরেট খাতে নারীর সমতা নিশ্চিতে আমাদের আরও অনেকখানি পথ পাড়ি দিতে হবে।
একটি সমাজে নারীর অবস্থা ও তার বিকশিত হওয়ার যে সুযোগ, তার ওপর নির্ভর করে নারী কর্মক্ষেত্রে কতটা জায়গা করে নিতে পারছেন। কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের আগের ধাপগুলোতে নারীরা কীভাবে তাঁর শিক্ষা সম্পন্ন করছেন, নানা অভিজ্ঞতা অর্জন করছেন, তার ওপর কর্মক্ষেত্রের সফলতা অনেকখানি নির্ভর করে। সমাজে আমরা কিছু ধারণা বহন করি, নারীদের জন্য বিশেষ কিছু কাজই মানানসই। নারীর এই বৃত্ত ভাঙার কোনো বিকল্প নেই।
ডিরেক্টর, করপোরেট অ্যাফেয়ার্স, পার্টনারশিপস অ্যান্ড কমিউনিকেশনস, ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড
মন্তব্য করুন