
প্রশ্নটি সবার মনেই খোঁচা দিচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ সারাদেশে যেসব ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিয়ে চলেছে, তার শেষ কোথায়? এর লাগাম টেনে ধরার মতো কেউ কি নেই সরকার বা সরকারি দলে? ছাত্রলীগ তো অভিভাবকহীন বখে যাওয়া যুবক বা তরুণ নয়; এর অভিভাবক রয়েছে এবং তারা ক্ষমতাধর। তারা দেশ শাসন করছে। তাদের হাতে প্রশাসন রয়েছে; আছে পুলিশ-র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর ব্যবহার-অপব্যবহার করে তারা বিরোধী মতের রাজনৈতিক দলকে কোণঠাসা করে রাখতে পারছে। কিন্তু ছাত্রলীগকে সামাল দিতে পারছে না। এটি অবিশ্বাস্য!
প্রায় এক দশক হলো, দেশব্যাপী ছাত্রলীগের তাণ্ডব চলছে। নেতিবাচক খবরের শিরোনাম সংগঠনটি কত শতবার হয়েছে, তার হিসাব রাখাও মুশকিল। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জমি দখল, ছিনতাই, অপহরণ, ধর্ষণ, খুনসহ অপরাধের এমন কোনো শাখা-প্রশাখা নেই; যেখানে এই ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনটির কর্মীরা বিচরণ করছেন না। অথচ একটি সোনালি অতীত রয়েছে এর। রয়েছে গৌরবময় ঐতিহ্য। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগের ধারাবাহিকতায় গঠিত হয়েছিল 'পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ'; যা পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নাম ধারণ করে। এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ অলি আহাদ তাঁর 'জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫' গ্রন্থে লিখেছেন- "মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভা ঢাকার ছাত্র মহল হইতে যত বিচ্ছিন্ন হইতেছিল, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সমর্থকবৃন্দের মর্যাদা ছাত্র মহলে ততই বৃদ্ধি পাইতেছিল। এই সময়ে অমি জাতীয় ও ছাত্র সমস্যা নিরসনের ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই নূতন ছাত্র সংগঠন গঠন করিবার তাগিদ অনুভব করি। তাই একমনা ছাত্র নেতৃবৃন্দের সহিত প্রাথমিক আলোচনা করিয়া ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি অপরাহেপ্ত ফজলুল হক মুসলিম হল মিলনায়তনে এক ছাত্র কর্মিসভা আহ্বান করি। সেই মুহূর্তে ঘটনাচক্রে ফেনী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক নাজমুল করিম উপস্থিত ছিলেন। আমরা তাঁহাকেই সভাপতি করিয়া সভার কাজ আরম্ভ করি। ...আমরা সর্বসম্মতিক্রমে 'পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ' গঠন করি। জনাব নইমুদ্দিন আহমদকে ও আমাকে আহ্বায়ক করে যথাক্রমে পূর্ব পাকিস্তান ও ঢাকা শহর কমিটি গঠন করা হয়।" পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সে কমিটির অন্য সদস্যরা ছিলেন- আবদুর রহমান চৌধুরী (বরিশাল), শেখ মুজিবুর রহমান (ফরিদপুর), অলি আহাদ (কুমিল্লা), আজিজ আহমদ (নোয়াখালী), আবদুল মতিন (পাবনা), দবিরুল ইসলাম (দিনাজপুর), মফিজুর রহমান (রংপুর), শেখ আবদুল আজিজ (খুলনা), নওয়াব আলী (ঢাকা), নূরুল কবির (ঢাকা সিটি), আবদুল আজিজ (কুষ্টিয়া), সৈয়দ নূরুল আলম (ময়মনসিংহ) ও আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী (চট্টগ্রাম)। (সূত্র : পূর্বোক্ত গ্রন্থ)
১৯৪৯ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারের বিপরীতে পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' গঠিত হলে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ তার সহযোগী সংগঠন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেই থেকে শুরু। তারপর এ দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্রলীগ ভ্যানগার্ড হিসেবে কাজ করেছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের আইয়ুববিরোধী গণআন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের ভূমিকা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।
আজকের ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাকালীন ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত সারটুকু তুলে ধরলাম এ জন্য- আজ যাঁরা সংগঠনটির সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাঁরা হয়তো এসব খবর রাখেন না। তাঁরা হয়তো এটাও জানেন না, এই ছাত্রলীগ থেকে জন্ম নিয়েছেন এ দেশের অনেক দেশবরেণ্য নেতা। ভাবতে অবাক লাগে আবার কষ্টও হয়, যে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাকালীন অন্যতম নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; সেই ছাত্রলীগের কর্মীরা কী করে সন্ত্রাসের পঙ্কে নিজেদের নিমজ্জিত করতে পারেন! নীতি-নৈতিকতার বালাই নেই এর নেতাকর্মীর একটি বড় অংশের মধ্যে! সংগঠনের পদ-পদবি ব্যবহার করে ব্যক্তিগত ফায়দা হাসিল আর প্রতিপক্ষ সংগঠনের ওপর মাস্তানি ফলানোই যেন তাঁদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ছাত্রলীগের কতিপয় নেতকর্মীর কাজকর্ম দেখে মনে হয়, এসব করার জন্য তাঁরা 'ওপেন জেনারেল লাইসেন্স' পেয়েছেন। কে কোন ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হলেন না-হলেন, তা দেখার দায়িত্ব তো তাঁদের নয়। দেশের সংবিধান যেহেতু প্রত্যেক নাগরিককে তাঁর পছন্দমতো রাজনৈতিক মতাদর্শ অনুসরণের অধিকার দিয়েছে, সেহেতু শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া কোনো অপরাধমূলক কাজ বলে গণ্য হতে পারে না। তাহলে কেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী 'শিবির সন্দেহ' বাতিকের বশবর্তী হয়ে একের পর এক নৃশংস ঘটনার জন্ম দিয়ে চলেছেন? বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর অনেকেই ভেবেছিলেন, হয়তো এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না। কিন্তু সম্প্রতি একইভাবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের চারজন শিক্ষার্থীকে বর্বরোচিত নির্যাতন করে মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এসব ঘটনা দেশবাসী, বিশেষ করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ূয়া শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তুলেছে। তাঁরা তাঁদের সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে যেমন উদ্বিগ্ন, তেমনি সরকারের ওপরও রুষ্ট হচ্ছেন।
একটা সময় ছিল, দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ঘটা করে নবীনবরণ অনুষ্ঠান হতো। কলেজ কর্তৃপক্ষ কিংবা ছাত্র সংসদ তা আয়োজন করত। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনও আলাদাভাবে নবীনবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। এর উদ্দেশ্য ছিল নতুন শিক্ষার্থীদের কাছে যার যার সংগঠনের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি তুলে ধরে তাঁদের দলভুক্ত করা। এটিই ছিল প্রচলিত প্রথা। এখন তো দেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নেই। তাই ওভাবে আর নবীনবরণ হয় না। তার পরিবর্তে এখন হলে সিট বরাদ্দসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে অথবা পেশি শক্তি প্রয়োগ করে নবীন শিক্ষার্থীদের দলে টানা হয়। এই সর্বনাশা প্রবণতার শেষ কোথায়, সেটিই প্রশ্ন।
একটি বিষয় অনেকেই ভেবে পাচ্ছেন না, ছাত্রলীগ প্রতিনিয়ত নানা অপকর্মের দ্বারা যে সরকারের ভাবমর্যাদায় কালি লেপন করে চলেছে, সরকার বা সরকারি দলের নীতিনির্ধারকদের কি তা কর্ণ বা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না? নাকি তাঁরা কানে তুলা দিয়ে আর চোখে টিনের চশমা পরে বসে আছেন? তাঁরা কি এটাও বুঝতে পারছেন না, যে উন্নয়ন-অর্জনের কথা বলে আত্মতৃপ্তিতে নিমগ্ন আছেন, ছাত্রলীগ তা ধূলিসাৎ করে দিচ্ছে? সচেতন ব্যক্তিরা বলছেন, এখনই যদি ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্যের লাগাম টেনে ধরা না হয়, তাহলে এর নেতিবাচক ফল আগামী সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোগ করতে হতে পারে।
মন্তব্য করুন