- চতুরঙ্গ
- সায়েন্স ল্যাব টু সিদ্দিকবাজার: সবই ‘নিষ্পাপ’ সিরিজ বিস্ফোরণ?
মতামত
সায়েন্স ল্যাব টু সিদ্দিকবাজার: সবই ‘নিষ্পাপ’ সিরিজ বিস্ফোরণ?

বুধবারের সকাল। মাদারীপুর থেকে ঢাকায় ফিরছি। শবেবরাতের সরকারি ছুটির দিন। মহাসড়ক এবং পরিবহনেও ছুটির ছাপ স্পষ্ট। কোথাও ভিড় নেই। বাসে যাত্রীদের চাপ নেই। কিন্তু কেরানীগঞ্জ পেরিয়ে বুড়িগঙ্গা সেতুতে উঠতেই গাড়ির গতি কমে এলো। বাবুবাজার পার হতে অনেক সময় লেগে গেল। নয়াবাজার মোড়ে আসতেই গাড়ি থেমে গেল। সামনে আর এগোনোর পথ নেই। জানালা দিয়ে বাইরে চোখ রাখতেই দেখা গেল সামনে গাড়ির লম্বা সারি। একপাশের সড়ক বন্ধ। অপর পাশের একটি সড়ক দিয়েই পাশাপাশি চলছে নয়াবাজার থেকে সদরঘাট এবং গুলিস্তানমুখী যানবাহন। চারপাশে তাকিয়ে যখন বুঝতে পারলাম এখান থেকে সহসাই গাড়ি নড়বে না, তখন নেমে হাঁটা শুরু করি। পায়ে হাঁটা মানুষের ভিড়, পুলিশের গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার যন্ত্র, সড়কে থাকা কাঁটাতারের গতিরোধক পেরিয়ে সিদ্দিকবাজারে আসতে প্রায় ১৫ মিনিট লেগে গেল।
মানুষের জটলার কাছে গিয়ে একজনের সঙ্গে আলাপ করার চেষ্টা করলাম। তিনিও নতুন কোনো তথ্য জানাতে পারলেন না। বললেন, দয়াগঞ্জ থেকে এসেছেন গতকালের দুর্ঘটনায় উদ্ধার অভিযান দেখতে। পাশেই দাঁড়ানো এক আনসার সদস্যের সঙ্গে কথা বললাম। সিদ্দিকবাজারে যে ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে, সেখানকার কোনো ব্যবসায়ীর খোঁজ জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, আজকে শবেবরাতের বন্ধ থাকায় আশপাশের এলাকা এমনিতেই বন্ধ থাকার কথা। এখন দুর্ঘটনার পরে খোলার আর সম্ভাবনা নাই। তিনিও তেমন কোনো সাহায্য করতে পারলেন না।
২.
অল্পদিনের ব্যবধানে পরপর তিনটি বিস্ফোরণের ঘটনা স্বাভাবিক কারণেই দেশবাসীর মনোযোগ কেড়েছে। রাজধানী ঢাকার গুলিস্তানের ব্যস্ততম এলাকা বিআরটিসি বাস কাউন্টারের পাশে সিদ্দিকবাজারের কুইন স্যানিটারি মার্কেট হিসেবে পরিচিত সাততলা ভবনে বিস্ফোরণে বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২০ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে এই বিস্ফোরণ কোন কারণে ঘটেছে, তা এখনও জানাতে পারেনি কেউ। তবে ভবনের ধ্বংসস্তূপ, আহত ও নিহত হওয়ার ধরন দেখে বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল মনে করছে, ভবনের বেজমেন্টের কোনো কক্ষে গ্যাস জমে সেটি ‘গ্যাস চেম্বারে’ পরিণত হয়েছিল। সেখানে যে কোনো উপায়ে আগুনের স্ফুলিঙ্গ থেকেই ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটেছে।
এর আগে বিস্ফারণের ঘটনা ঢাকার সাইন্স ল্যাব এলাকায়। সেই দুর্ঘটনায় তিনজনের প্রাণহানি হয়েছিল। এরপরে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে। আবার আরেকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। তবে সীতাকুণ্ডের দুর্ঘটনাটি অন্যগুলোর থেকে আলাদা। এটি শিল্পকারখানায় সংঘটিত দুর্ঘটনা, যেখানে প্রচণ্ড চাপ উৎপন্ন হয়ে অক্সিজেন ট্যাঙ্ক ও সেপারেশন ইউনিট বিস্ফোরিত হয়েছে এবং বিস্ফোরণ-পরবর্তী অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে বলে জানা গেছে।
তবে এবার প্রতিটি দুর্ঘটনার ব্যাপ্তি আলাদা হলেও ঢাকার সায়েন্স ল্যাবের কাছের ভবন, সিদ্দিকবাজারের ভবন ও ২০২১ সালে মগবাজারের দুর্ঘটনাগুলো একই প্রকৃতির। যেখানে জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন। ঢাকার সায়েন্স ল্যাবের কাছের ভবনে বিস্ফোরণ হয়েছিল ভবনের তিনতলায়। সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণের স্থল ভবনের বেজমেন্টে।
আমাদের দেশে এ ধরনের প্রায় প্রতিটি দুর্ঘটনার পরই যেটি বেশি শোনা যায়, তা হলো– ভবন তৈরির সময় নিয়ম মানা হয়নি। ভবনে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা কার্যকর ছিল না। গ্যাসের লাইনে ত্রুটি ছিল। প্রতিবারই শোনা যায়, আগামীতে ভবন মালিকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সিটি করপোরেশন বা রাজউকের দয়িত্বপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু কাজের কাজ যে কিছুই হয় না, একের পর এক এমন ঘটনাই তার প্রমাণ।
তবে এবারের কাছাকাছি সময়ে তিনটি ঘটনা নিয়ে বুধবার থেকেই নতুন নতুন বক্তব্য আসতে শুরু করেছে। চার দিনের ব্যবধানে তিনটি ঘটনার কারণ সম্পর্কে এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া না গেলেও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কথার লড়াই শুরু হয়ে গেছে। আর এই ক্ষেত্রেও দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ‘কথার লড়াই’ চলছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যেমন সরকারকে দায়ী করছেন, তেমনি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপিকে আক্রমণ করে বক্তব্য রাখছেন। বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, গত কয়েকদিন ধরে দেখছেন শুধু বিস্ফোরণ হচ্ছে। কীভাবে বিস্ফোরণ হচ্ছে? সরকারের যে ডিপার্টমেন্টগুলো আছে, যাদের এসব ভবন দেখাশোনা করার কথা, যাদের নজরদারি করার কথা, তারা কাজ করে না, সব দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। তিনি আরও বলেছেন, এসব বিস্ফোরণের ধরন প্রায় একই রকম হওয়ায় জনমনে সন্দেহ বাড়ছে। এসব ঘটনা পরিকল্পিত কিনা, তাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে গুলিস্তান, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অগ্নিসংযোগের ঘটনা বিএনপি ঘটিয়েছে কিনা, সরকার তা খতিয়ে দেখছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বুধবার সকালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে মহানগর, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাদের এক যৌথ সভায় এসব কথা বলেছেন তিনি।
আবার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ গুলিস্তানের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেছেন, রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের ঘটনা প্রকৃত দুর্ঘটনা নাকি অন্তর্ঘাতমূলক কিছু, তার সঠিক তদন্ত প্রয়োজন।
৩
সায়েন্স ল্যাব থেকে সিদ্দিকবাজারের এই বিস্ফোরণের সব ঘটনাই ‘নিষ্পাপ’ বিস্ফোরণ কিনা এমন প্রশ্ন এখন আমাদের মনেও হাজির হয়েছে। বিশেষ করে, এই ধরনের ঘটনার পরে ভবনের মালিকসহ দোষীদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নজির আমাদের সামনে এখনও নেই। বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুন, চকবাজারের রাসায়নিকের গুদামে আগুন থেকে শুরু করে সীতাকুণ্ডের শিপইয়ার্ডে আগুন কোনো ঘটনারই বিচার না হওয়া এই ধরনের বিস্ফোরণ নিয়ে প্রশ্ন দিন দিন জোরালো হয়ে উঠছে। প্রতিটি ঘটনার পরেই মৃতব্যক্তির পরিবারকে ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি দিলেই কি সব সমাপ্ত হয়ে যায়? এইসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত ভবনমালিকের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আমলে না নিয়ে নিরপেক্ষভাবে আইনিভাবে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। একইভাবে সরকারি প্রতিষ্ঠান যে সবের কাজ ভবনের তদারকি করা তাদের দায়িত্বে অবহেলাকারীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
বাংলায় একটি প্রবাদ গ্রামগঞ্জে এখনও বেশ উচ্চারিত হয়, সেটি হলো– ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পোড়া। সম্প্রতি কাছাকাছি সময়ে তিনটি জায়গায় বিস্ফোরণের ঘটনায় রাজনৈতিক নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পোড়ার বিষয়টিই আবার সামনে নিয়ে এসেছে।
মন্তব্য করুন