বাংলাদেশ বিশ্বের মাদক উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে না পড়লেও আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানের রুট এবং অবৈধ মাদকদ্রব্যের বাজারে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের পর্যটন এলাকা হিসেবে পরিচিত কক্সবাজার ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে এখন মাদকের প্রবেশদ্বার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কক্সবাজার বাংলাদেশের সবচেয়ে অপরাধপ্রবণ জেলা। কক্সবাজারে প্রতি ৯৫ জন ব্যক্তির মধ্যে গড়ে একটি করে ফৌজদারি মামলা আছে (সূত্র: ১৭ নভেম্বর ২০২২, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড)। 

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এশিয়ার তিনটি মাদক চোরাচালানের অঞ্চল হিসেবে পরিচিত গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল, গোল্ডেন ক্রিসেন্ট ও গোল্ডেন ওয়েজের কেন্দ্রস্থলে হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক মাদক চোরাকারবারিরা বাংলাদেশকে মাদক পাচারের একটি সহজ রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। বিশেষ করে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলের অন্তর্ভুক্ত দেশ মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের জল ও স্থলসীমানা রয়েছে। প্রথম দিকে হেরোইন, ফেনসিডিল বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করলেও পরবর্তী সময়ে ইয়াবা আইস বা ক্রিস্টাল মেথের ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এর প্রধান কারণ গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল ও গোল্ডেন ক্রিসেন্টের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোতে ব্যাপক হারে ক্রিস্টাল মেথের উৎপাদন বেড়েছে। এই উৎপাদিত মাদকদ্রব্যের একটি বড় বাজার হিসেবে তারা টার্গেট করেছে জনবহুল বাংলাদেশকে। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০২ সালে সারাদেশে ইয়াবা জব্দ হয়েছে ৪ কোটি ৫৮ লাখ ৬৮ হাজার ৫৬৯টি (সূত্র: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, সমকাল)।

এ পটভূমিতে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম শহর ও কক্সবাজার জেলাকে ‘মাদকপ্রবণ অঞ্চল’ হিসেবে ঘোষণা করে মাদক কারবারের বিরুদ্ধে সরকারের কড়া অবস্থান নিশ্চিত করেছে। এই দুই এলাকাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মাদকপ্রবণ অঞ্চল’ ঘোষণা কার্যক্রম এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। বিশ্বের অনেক দেশেই মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সময় বিশেষ এলাকাকে এ রকম মাদকপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত করে অভিযান চালানোর নজির রয়েছে। মাদকপ্রবণ অঞ্চলের ঘোষণা দেওয়ার মানে হচ্ছে, এই এলাকায় মাদক ব্যবসার মতো সমস্যা আছে স্বীকার করে নিয়ে সরকার তা সমাধানের কথা চিন্তা করছে। সরকারের এরূপ পদক্ষেপে লাভ হবে তখনই যখন সীমাবদ্ধতাগুলো চিহ্নিত করে তা দূরীকরণে বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ক্ষমতাসীন দলের ছত্রচ্ছায়ায় রাজনৈতিক নেতাকর্মী থেকে শুরু করে এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, এমনকি নারী ও শিশুরাও অর্থের জন্য মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। অনেক সময় এসব অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে, এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধেও। মিয়ানমার থেকে আসা বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া দেশের জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের চলাচল ও যোগাযোগ সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। সেই সঙ্গে মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত রোহিঙ্গাদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার জন্য প্রয়োজনে স্বতন্ত্র আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে। সীমান্তে চোরাচালান বন্ধে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কড়া নজরদারির পাশাপাশি উন্নত প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।

মানবদেহ, জননিরাপত্তা ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি এই মাদক ব্যবসা। মাদক ব্যবসা অবৈধ হলেও এটি একটি লাভজনক ব্যবসা এবং এর নেটওয়ার্ক বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত। মাদকদ্রব্যের ব্যাপক চাহিদা থাকার কারণেই এ ব্যবসা এত প্রসার লাভ করেছে। বাংলাদেশে মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা খুব সহজেই অবৈধ উপায়ে বিপুল অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে বিলাসী জীবন যাপন করছে এবং অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছে। তাদের অবৈধ কারবার টিকিয়ে রাখার জন্য দেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। এমন অনেক উদাহরণ আছে, যারা মাদক ব্যবসাকে পেশা হিসেবে নিয়েছে, তারা জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরেও মাদক ব্যবসায় ফিরে গেছে। মাদক ব্যবসা থেকে উপার্জিত অর্থ সংঘবদ্ধ অপারাধী চক্রের আয়ের বড় উৎস হিসেবে কাজ করে এবং বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি, মানি লন্ডারিংকে উৎসাহিত করে। মাদক কারবারিরা নারী ও শিশু পাচারেরও জড়িত। একটি অপরাধের সঙ্গে আরেকটি অপরাধের যোগসূত্র রয়েছে। মাদক ব্যবসা থেকে উপার্জিত অবৈধ অর্থ ব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধী চক্র রাষ্ট্র, প্রশাসন ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলে এবং সুশাসন ব্যাহত করে। বলিভিয়া, ব্রাজিল, মেক্সিকো, পেরু, গুয়াতেমালার অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে মাদক ব্যবসা থেকে উপার্জিত অর্থ রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থায়নের বড় উৎস হিসেবে কাজ করেছে এবং সেই সঙ্গে বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি করেছে– যা দেশের আইনের শাসন ও বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন সময়ে মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে। দেখা যায়, মাদকের বাহক গ্রেপ্তার হলেও মূলহোতা ও পৃষ্ঠপোষকরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। মাদক ব্যবসায়ীদের টার্গেট হচ্ছে দেশের যুবসম্প্রদায়। এর মধ্যে একটি বড় অংশ স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থী। যেহেতু মাদক ব্যবসা একেবারে নির্মূল করা কঠিন, তাই যুবসম্প্রদায়ের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখার পাশাপাশি সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে যুবসমাজ ও জনসাধারণকে সচেতন করা যেতে পারে। পুলিশ, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থাকে দুর্নীতিমুক্ত না করা গেলে, অর্থাৎ ‘পলিসির’ পাশাপাশি ‘স্ট্রাকচারাল চেঞ্জ’– এ দুইয়ের সমন্বয় ছাড়া মাদক কারবারিদের নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব ব্যাপার। তাই সরকারের ‘মাদকপ্রবণ অঞ্চল’ ঘোষণার মাধ্যমে মাদক ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণ কতটুকু ফলপ্রসূ হবে– তা আগামী দিনই বলে দেবে।