
বর্তমানে আমাদের দেশে গবেষণার সংস্কৃতির কথা বলা হচ্ছে, কারণ গবেষণাকে সংস্কৃতিতে রূপান্তরকরতে পারলে গবেষণামনস্ক মানুষ তৈরির স্বপ্ন সফল হবে। তখন গবেষণামনস্ক মানুষদের গবেষণালব্ধ ফলাফল ও ধারণার সঙ্গে অর্থনীতির যোগসূত্র ঘটানো সম্ভব হবে। যে কোনো গবেষণার মূল উদ্দেশ্য মানবকল্যাণ হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর অর্থনৈতিক গুরুত্বও বাড়ছে। যে কোনো প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের সঙ্গে গবেষণার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। প্রোডাক্ট লাইফ সাইকেল থিওরিতে বলা হচ্ছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পপণ্যেরও চাহিদাগত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এই থিওরিতে দেখানো হয়েছে– একটি
শিল্পপণ্যকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চারটি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। এগুলো হলো– নতুন পণ্যের আগমন, এর চাহিদা ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি, এর ম্যাচিউরিটি লেভেলে পৌঁছানো ও একসময় এর পতন বা হ্রাস। এগুলো নির্ভর করে পণ্যের গুণগতমানের পরিবর্তনের হার, সময়, ক্রেতার পছন্দ ও চাহিদার ওপরে। শিল্পকারখানাগুলোর চেষ্টা হলো শিল্পপণ্যের পতন বা হ্রাস কীভাবে রোধ করে এটির চাহিদা ম্যাচুউরিটি লেভেলে পৌঁছানোর পর একই লেভেলে দীর্ঘ সময় ধরে রাখা যায় বা
টেকসই করা যায়। মূলত চ্যালেঞ্জ এখানেই। যেখানেই চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে সেখানেই গবেষণার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সারা পৃথিবীর বড় শিল্পকারখানাগুলো যে কোনো
ধরনের শিল্পপণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। এর প্রধান কারণ হলো– একই ধরনের শিল্প উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিল্পকারখানাগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হলে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের কোনো বিকল্প নেই। রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্ট খাতে ব্যয় বরাদ্দের মাধ্যমে এটি তারা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। মূলত এই বিষয়টিকে তারা ব্যয় হিসেবে বিবেচনা না করে বিনিয়োগ হিসেবে চিহ্নিত করছে। সেক্ষেত্রে তারা গবেষণার মাধ্যমে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের মাধ্যমে যেমন নিজেদের রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্ট ডিপার্মেন্টকে কাজে লাগাচ্ছে, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরসহায়তায়ও তারা নিজেদের শিল্পপণ্যের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের বিষয়টি নিশ্চিত করছে। এই গবেষণার বিষয়টি হালকা, মাঝারি, ভারী সব পণ্যের ক্ষেত্রেই বিবেচনা করা হচ্ছে। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকেও শিল্পকারখানাগুলো তাদের পণ্যের ক্রমাগত উন্নয়নে গবেষণার সুবিধা নিতে পারে। এছাড়া নতুন পণ্যের ধারণা তৈরিতে শিল্পকারখানাগুলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কাজে লাগাতে পারে। তবে ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়ার ধারণাকে এখনও পর্যন্ত আমাদের দেশে সেভাবে বাস্তবে রূপ দেওয়া যায়নি। এখন যতটুকু হচ্ছে, সেটিকে সফল বলার চেয়ে একধরনের প্রচারণাসর্বস্ব বিষয় হিসেবেই বিবেচনা করা যেতে পারে। এই ধরনের নেতিবাচক অবস্থার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্পকারখানা উভয়ের মধ্যে অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা কাজ করছে। কিন্তু বিষয়গুলো ইতিবাচকভাবে ঘটার কথা থাকলেও তা ঘটছে না। শিল্পকারখানাগুলো তাদের সমস্যার সমাধান ও শিল্পপণ্যের উৎকর্ষের জন্য সবধরনের সহযোগিতার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণায় সম্পৃক্ত করতে পারে। এতে করে দু’পক্ষই সুবিধা পেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিল্পকারখানা থেকে প্রাপ্ত সহযোগিতার মাধ্যমে মাস্টার্স ও পিএইচডির শিক্ষার্থীদের স্কলারশিপ দেওয়ার মাধ্যমে শিল্পকারখানার চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলায় সার্বক্ষণিক গবেষণার পরিবেশ গড়ে তুলতে পারত। এতে করে উন্নত দেশগুলোর মতো আমাদের দেশেও ল্যাবরেটরিভিত্তিক গবেষণার পথ উন্মুক্ত করা সম্ভব হতো। এছাড়া আন্ডারগ্র্যাজুয়েট লেভেলের শিক্ষার্থীদেরও এসব গবেষণার সঙ্গে যুক্ত করা সম্ভব হতো। অনেকে মনে করেন, আন্ডারগ্র্যাজুয়েট লেভেলের শিক্ষার্থীদের পরিধি কেবল শিক্ষাদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এমন গতানুগতিক ধারণা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে শিক্ষাদানের পাশাপাশি নতুন জ্ঞানের উদ্ভাবনও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়টি বিবেচনায় রেখে আন্ডারগ্র্যাজুয়েটের শিক্ষার্থীদের পোস্টগ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গবেষণা সহায়ক শক্তি হিসেবে যুক্ত করার সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বিভিন্ন বিষয়ের সম্মিলনে গবেষণার নতুন ভাবনা গড়ে তুলছে। যেটিকে ইন্টিগ্রেটেড রিসার্চ কিংবা মাল্টিডিসিপ্লিনারি রিসার্চ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। উন্নত বিশ্বে এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে কারিকুলামেও পরিবর্তন ঘটছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মতো বিষয়গুলো সব শাখার শিক্ষার্থীদের জন্য অপরিহার্য শিক্ষা উপাদান হিসেবে প্রাধান্য পাচ্ছে। ন্যানোটেকনোলজির সঙ্গে চিকিৎসাবিজ্ঞান, এনার্জি স্টোরেজ, বায়োটেকনোলজি, ন্যানো ও অপটো ইলেকট্রনিক, নবায়নযোগ্য জ্বালানির মতো বিষয়গুলোর যোগসূত্র গড়ে উঠছে। অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, মনস্তত্ব, দর্শনের সঙ্গেও প্রযুক্তির সম্পৃক্ততা সৃষ্টি হচ্ছে। কারণ, কেবল প্রযুক্তিগত উন্নয়ন করলেই চলবে না, এর সঙ্গে মানুষ পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে কতটা খাপ খাইয়ে নিতে পারছে সেগুলোর দৃষ্টিভঙি ও আচরণগত বিষয়গুলো নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে টেকনোলোজিক্যাল চেঞ্জ অনেক বেশি হওয়ায় এই পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের কীভাবে আপডেট করা যায় সেই চ্যালেঞ্জগুলো নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। শিল্পকারখানাগুলোকে দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। আমাদের দেশের শিল্পকারখানাগুলোর মূল সমস্যা হলো, তারা শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়গুলোকে দীর্ঘমেয়াদে চিন্তা করে না। পণ্য উৎপাদনের অনেক প্রয়োজনীয় উপাদানের জন্য তাদের মধ্যে বিদেশনির্ভরতা দেখা যায়। গত অর্থবছরে পোশাক খাতে কাঁচা তুলা, কৃত্রিম সুতা, তুলাজাত সুতা এবং বস্ত্র ও অ্যাকসেসরিজের মতো কাঁচামাল আমদানি করতে ব্যয় হয় ১ হাজার ২৮৫ কোটি ৬১ লাখ ৬০ হাজার ডলার, যা মোট রপ্তানির ৪০ দশমিক ৮৬ শতাংশ। প্রতিবছর আমাদের দেশের ওষুধশিল্পের ৮০% থেকে ৮৫% কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে গিয়ে এই খাতে এক দশমিক তিন বিলিয়ন ডলার ব্যয় হচ্ছে। গত অর্থবছরে দেশের ২৫০ প্লাস্টিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্রায় ৪৭ কোটি ডলার ব্যয় করে ৩ লাখ ২৬ হাজার টন পিভিসি আমদানি করেছে এবং পেট রেজিন বাবদ ব্যয় করেছে ২৭ কোটি ডলার। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাকে এগিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে আমদানি করা কাঁচামালগুলো দেশে উৎপাদনের পরিবেশ তৈরি করতে তারা ভূমিকা রাখতে পারত। দেশের বিভিন্ন উৎস থেকে সেই কাঁচামালগুলো উৎপাদনের বিকল্প পন্থা বের করার গবেষণায় তারা দেশের গবেষকদের কাজে লাগাতে পারত, তখন দেশের অর্থ দেশেই থেকে যেত। গবেষণার মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে নিজেদের এগিয়ে নেওয়া দরকার। বৈশ্বিক বিভিন্ন সংকটে নিজেদের সম্পদের ওপর নির্ভর করে দাঁড়ানোটাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ, যেটা মোকাবিলায় গবেষণার কোনো বিকল্প নেই।
পৃথিবীর অনেক বড় বড় শিল্পকারখানা গবেষণার মাধ্যমে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও ধারণাকে প্রাধান্য দেয়নি বলে একসময় তাদের দেউলিয়া ঘোষণা করতে হয়েছে। ১৮৮৮ সালে হেনরি স্ট্রংকে সঙ্গে নিয়ে জর্জ ইস্টম্যান ‘ইস্টম্যান কোডাক’ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৯০-এর দশকেও পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি ব্র্যান্ডের মধ্যে কোডাক ছিল অন্যতম। সারা পৃথিবীতে তাদের প্রায় দেড় লাখ কর্মী গর্ব নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। প্রচিলত আছে যে যুক্তরাষ্ট্রের ৮৫% থেকে ৯০% ফিল্ম ও ক্যামেরার বাজার কোডাকের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
কোডাকে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত স্টিভেন স্যাসন ১৯৭৫ সালে ফিল্মবিহীন ডিজিটাল ক্যামেরা আবিষ্কার করেন। কিন্তু সে সময়ের কোডাকের ম্যানেজমেন্ট স্টিভেন স্যাসনকে তাঁর আবিষ্কারের বিষয়টি গোপন রাখতে বলেন ও তখনকার ফিল্মযুক্ত ক্যামেরার লাভজনক ব্যবসা নিয়ে এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। কেবল লাভের বিষয়টি মাথায় রেখে উন্নত প্রযুক্তি গ্রহণ না করার মাসুল দিতে হয়েছিল ১৩০ বছর ধরে ক্যামেরা ব্যবসায় আধিপত্য বিস্তারকারী এই প্রতিষ্ঠানটিকে। ইতোমধ্যে সনি, ক্যানন, নাইকন ও অলিম্পাসের মতো কোম্পানিগুলো ক্যামেরার আধুনিক ধ্যান–ধারণার রূপ ও বৈচিত্র্য বাজারে নিয়ে এলে কোডাক ক্রমাগত পিছাতে থাকে এবং ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালতে আইনের ১১ ধারা অনুযায়ী নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে।
আমাদের গতানুগতিক ধারণা হচ্ছে, গবেষণা কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। এটা এক ধরনের ভুল ধারণা। বরং গবেষণা চর্চার যাত্রাটা শুরু হওয়া উচিত শৈশব থেকেই। শিক্ষার সব স্তরে গবেষণা চর্চাকে ছড়িয়ে দিয়ে উদ্ভাবনমুখী মানুষ গড়তে হবে। তবেই দেশ উদ্ভাবনের সঙ্গে অর্থনীতির নিবিড় বন্ধন গড়ে এগিয়ে যাবে।
মন্তব্য করুন