ঢাকা মহানগরীতে একই দিনে বড় দুটি দলের কর্মসূচি পালনকালে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করে। যে কোনো সময় উভয় দলের নেতাকর্মীর মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ইতোমধ্যে কয়েক জায়গায় এমন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটার পরও শনিবার সকালে বিএনপি যখন নয়াপল্টনে তাদের দলীয় কার্যালয়ের সামনে পূর্বঘোষিত মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে, ঠিক একই সময় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগ তাদের দলীয় কার্যালয়ের সামনে পূর্বঘোষিত শান্তি সমাবেশ করে। বিএনপি তাদের মানববন্ধন থেকে নিত্যপণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতি ও বিদ্যুতের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে এবং সরকারের পদত্যাগসহ ১০ দফা দাবিতে আগামী শনিবার দেশের সব মহানগরে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে; আওয়ামী লীগও যে সেদিন কোনো না কোনো কর্মসূচি পালন করবে, তা গত কয়েক মাসের অভিজ্ঞতায় বলা যায়।

রাজনৈতিক মাঠের দখল বিরোধী দলের হাতে না ছাড়ার কৌশল হিসেবে সরকারি দলের এ চর্চা অতীতেও দেখা গেছে। তাই এর নৈতিকতার ভিত্তি নিয়ে কিছু না বলে দল দুটির কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই– তাদের কর্মসূচি পালনের জন্য শনিবারটিকে বেছে নেওয়ার হেতু কী? হয়তো তারা বলবে– কর্মদিবসে কর্মসূচি পালন করলে নগরীতে যানজটের তীব্রতা বাড়বে। নগরবাসীর স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে সাপ্তাহিক ছুটির দিনটিকে তারা বেছে নিচ্ছে। কিন্তু শনিবার সরকারি অফিস, আদালত, ব্যাংক বন্ধ থাকলেও বেসরকারি অফিস, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, পোশাক কারখানার মতো গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন খাত সচল থাকে। এর সঙ্গে যুক্ত কর্মীকে কর্মস্থলে যাতায়াত করতে হয়। মাসে এক শনিবার হলে ভিন্ন কথা। প্রতি শনিবারে বিএনপি রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করলে এবং আওয়ামী লীগও মাঠে থাকার কথা বলে সভা-সমাবেশ করলে কর্মস্থলমুখী যাত্রীদের যানজটের যাতনা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কি দল দুটি ভেবে দেখেছে?

আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ দলীয় কার্যালয়ের সামনে হলেও কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে খণ্ড খণ্ড মিছিল আসে; সেসব মিছিলের কারণে সংশ্লিষ্ট সড়কগুলোয় যান চলাচল ব্যাহত হয়। সমাবেশ শুরুর আগেই এসব মিছিল সমাবেশস্থলে পৌঁছা উচিত হলেও দেখা যায়, প্রধান অতিথির বক্তব্যের সময়ও কোনো কোনো মিছিল ব্যানার নিয়ে সমাবেশস্থলে উপস্থিত হচ্ছে।

দলীয় নেতাকর্মীকে যে শৃঙ্খলার মধ্যে আনা যাচ্ছে না, তা আওয়ামী লীগ-বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের মন্তব্যেই বোঝা যায়। নিকট অতীতে দলীয় নেতাকর্মীকে স্লোগান বন্ধ করার জন্য বারবার অনুরোধ করে ব্যর্থ হয়ে চটে যেতে দেখা গেছে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে। পরে মহানগর নেতাদের সহায়তায় পরিস্থিতি অনুকূলে আনতে হয় তাঁকে।

১১ মার্চ দলীয় নেতাকর্মীর বিশৃঙ্খল আচরণে চটে যেতে দেখা গেছে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামকে। সমকাল অনলাইনে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, ‘নেতাকর্মীর উদ্দেশে কামরুল ইসলাম বলেন, একটা প্রশ্ন করি। আপনারা সবাই মন্নাফি ও হুমায়ুনের কর্মী। মন্নাফি যখন বক্তব্য দেবেন তখন দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে হবে, পাগলের মতো। হুমায়ুন কবিরের নাম শোনামাত্র আপনারা পাগলের মতো স্লোগান দিতে থাকেন। আজ বিএনপির যে সমাবেশ হচ্ছে, বিএনপির কর্মসূচি বড় কিন্তু, একেবারে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু আপনারা সবাই ব্যানারটা উঁচিয়ে রেখেছেন অথচ মন্নাফি ও হুমায়ুনের কথা শোনেন না। আপনারা কি চান না– এ সমাবেশটা বিএনপির কর্মসূচি থেকে বড় হোক। এটা যদি চান তাহলে ব্যানার নামিয়ে ফেলেন।’ সাবেক মন্ত্রী কামরুল ইসলামের এ বক্তব্যের মধ্যে দলীয় নেতাকর্মীর বিশৃঙ্খলার পরিচয় প্রকাশের পাশাপাশি আরেকটি বার্তা পাওয়া যায়– বিএনপির চেয়ে বেশি কভারেজ ও বড় কর্মসূচি দেখানোর মানসিকতা। সরকারি দল জনগণের ম্যান্ডেট নিয়েই রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে। বিরোধী দলের কর্মসূচির দিন পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে নিজেদের অবস্থান জানান দেওয়ার কী দরকার?

বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শান্তি সমাবেশে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির এক সদস্য বলেছেন, বিএনপির পায়ের তলায় মাটি নেই। একই সময় নয়াপল্টনে বিএনপি নেতারা দাবি করেছেন, সরকারের শেষ সময় চলে এসেছে। উভয় দলের বাগ্যুদ্ধ চলছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এ ধরনের কথাবার্তা চলতেই পারে। বিরোধী দল আন্দোলন করবে, সরকারি দল মাঠে থাকবে। সংঘর্ষে না জড়ালে এসব পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষের কিছু যায় আসে না। কিন্তু কর্মসূচির কারণে সড়কে যানজট সৃষ্টি হলে যাত্রীরা বিরক্ত হন, বিড়ম্বনায় পড়েন। তাই উভয় দলকেই রাজপথের কর্মসূচি পরিহার করে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে চলে আসা উচিত। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সুদূর লন্ডন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে নেতাকর্মীর সঙ্গে বৈঠক করছেন। আইনের দৃষ্টিতে দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি হওয়ায় উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় সংবাদমাধ্যম তাঁর বক্তব্য প্রকাশ বা সম্প্রচার করতে পারছে না। টেমস নদীর তীর থেকে বুড়িগঙ্গা তীরের শহর ঢাকায় ভিডিও কনফারেন্স করতে পারলে তাদের দলীয় কর্মসূচি ডিজিটালি করা যাবে না কেন?

যদি মনে করেন, ডিজিটাল আন্দোলনে চলবে না তাহলে বিকল্প কিছু বের করুন যাতে অন্তত জনগণের ভোগান্তি এড়ানো যায়। একই সঙ্গে সরকারি দলেরও উচিত ‘অরাজকতা ঠেকানোর’ নামে পাল্টা কর্মসূচি দেওয়া থেকে বিরত থাকা। বিরোধী দল সহিংস কিছু ঘটালে তা দেখার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আছে। প্রতি শনিবার কর্মসূচি দিয়ে কর্মস্থলমুখী মানুষকে বিড়ম্বনায় ফেলা উচিত নয়। 

মিজান শাজাহান: সহসম্পাদক, সমকাল।