ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক, প্রশাসনিক ভবনের পাশাপাশি আবাসিক হলের বেশিরভাগই পাঁচ-ছয়তলাবিশিষ্ট। দ্বিতল ভবনের হলও রয়েছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সুউচ্চ ভবন নির্মিত হয়েছে দেশের সেরা এ বিদ্যাপীঠে। একাডেমিক ভবন হিসেবে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের জন্য যেমন বহুতল ভবন নির্মিত হয়েছে, একইভাবে সুফিয়া কামাল হলসহ নতুন সুউচ্চ আবাসিক ভবনগুলো আধুনিক স্থাপত্যের ছোঁয়া পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু ও শেখ রাসেলের নামে নির্মিত হয়েছে টাওয়ার। এরপরও আবাসিক হলে গণরুমের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ পরও গণরুমের ভোগান্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।

একজন শিক্ষার্থী বসবাস ও লেখাপড়ার উপযুক্ত পরিবেশ এবং পুষ্টিকর খাবারের নিশ্চয়তা না পেলে কীভাবে মেধার বিকাশ ঘটাবে? বলার অপেক্ষা রাখে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী মফস্বল থেকে আসেন। ফলে এই নগরীর নবাগত বাসিন্দা হিসেবে ঠাঁই নিতে চান আবাসিক হলে। প্রথম বর্ষে অনেকেই সেই সুযোগ পান না। যাঁরা পান তাঁদের আশ্রয় নিতে হয় ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের ছাতার নিচে। আশ্রয় পাওয়া শিক্ষার্থীদের নিয়মিত যোগ দিতে হয় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে। এ পর্যন্ত হলে কথা ছিল না। ছাত্র সংগঠনের হল শাখা, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা এমনকি কেন্দ্রীয় শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে গ্রুপিং রয়েছে। পাশাপাশি বসে সভা-সমাবেশ করেন এবং সবসময় সংবাদমাধ্যমের কাছে গ্রুপিংয়ের বিষয়টি অস্বীকার করলেও এটি সত্য, তাঁরা নিজস্ব অনুসারী তৈরিতে ব্যস্ত থাকেন।

অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণে থাকে হলের বিভিন্ন কক্ষ। হলের কক্ষ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের কথামতো না চললে বা তাঁদের অনুসারী না হলে গণরুমেও শান্তিতে থাকা যায় না। বৃহস্পতিবার সমকাল অনলাইনে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, ‘হল থেকে বের করে দেওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন স্যার এএফ রহমান হলের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্ররা। বুধবার (১৫ মার্চ) রাত দেড়টার দিকে এ অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন তাঁরা। তবে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের আশ্বাসে রাত ২টা ৪০ মিনিটে সেখান থেকে সরে যান বিক্ষোভরত ছাত্ররা। বিক্ষোভরত ছাত্ররা জানান, ঢাবির স্যার এএফ রহমান হলের ১১১ নম্বর কক্ষে ৪৩ জন ছাত্র থাকেন। কক্ষটিতে চারজনের জায়গায় সর্বোচ্চ আটজন থাকা সম্ভব। অথচ সেখানে থাকেন ৪৩ জন শিক্ষার্থী। শুধু তাই নয়, ওই কক্ষে থাকার জন্য তাঁদের নিয়মিত রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যাওয়া, গেস্টরুমসহ নানা নির্যাতন ও অপমান সহ্য করতে হয়। তাই ক্ষোভ থেকে তাঁরা এই বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। ছাত্ররা বলছেন, এএফ রহমান হলের ওই কক্ষটি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের নিয়ন্ত্রণাধীন।’

আবাসিক হলের একটি কক্ষে এত শিক্ষার্থী থাকলে পড়ালেখার পরিবেশ তো দূরের কথা, তাঁদের ঘুমানোর জায়গাও হওয়ার কথা নয়। বাজেটে শিক্ষা খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিতের তাগিদ দিচ্ছেন। বিশ্বে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে কি এমন নজির পাওয়া যাবে? দরকার হলে পর্যায়ক্রমে আবাসিক হলগুলোকে সুউচ্চ ভবনে রূপান্তর করা হোক। তারপরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণরুম সংস্কৃতির অবসান হোক। আমরা দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠটিকে পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে দেখতে চাই। মফস্বলের কোনো কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর প্রবাসজীবনটা যেন নিরাপদ হয়। আর কোনো শিক্ষার্থীকে যেন রাতের আঁধারে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে আন্দোলনে যেতে না হয়।

অনুসারী এবং গ্রুপিং সংস্কৃতিও চলতে দেওয়া যায় না। ছাত্রলীগের বর্তমান শীর্ষ দুই নেতার উভয়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী। একই ব্যাচের হওয়ায় তাঁদের মধ্যে বোঝাপড়াও ভালো বলে মনে করি। উত্তরের জেলা পঞ্চগড় এবং দক্ষিণের জেলা ঝালকাঠি থেকে উঠে আসা এ দুই নেতা নিশ্চয়ই গণরুমের ভোগান্তি উপলব্ধি করতে পারবেন। স্বজনদের গ্রামে রেখে রাজধানীতে এসে পড়ালেখা করার বাস্তবতা নটর ডেম কলেজে এইচএসসিতে পড়াকালীনই ছাত্রলীগ সভাপতির উপলব্ধি করার কথা। তাই বিশ্ববিদ্যালয় ও হল প্রশাসন এবং ছাত্র সংগঠনগুলোর সদিচ্ছা থাকলে চলমান এ সংকটের সমাধান সম্ভব।