দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অমীমাংসিত আলোচনার মধ্যেই নির্বাচন কমিশন (ইসি) দেশের ৫ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করেছে। আগামী ২৫ মে গাজীপুর, ১২ জুন খুলনা ও বরিশাল এবং ২১ জুন রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অবশ্য ২০১৪ ও ২০১৮ সালের আলোচিত-সমালোচিত নির্বাচনের কারণে এখন ৫ সিটি নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ কতখানি থাকবে, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

 সিটি নির্বাচনটি এমন সময় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যখন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যালটের মাধ্যমে ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে ইসি। যদিও শুরুতে অর্ধেক আসন ইভিএমে করার কথা জানানো হয়েছিল। পরে অবশ্য সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়েছে। এখন ঘোষিত সিটি নির্বাচন ইভিএমে অনুষ্ঠিত হবে বলা হয়েছে। তবে ব্যালট পেপার কিংবা ইভিএম– দুটির কোনোটিতেই আগ্রহ দেখাচ্ছে না দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি। তারা বলে আসছে তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচনে যাবে না।

এমনকি এই সরকারের অধীনে আর কোনো স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনেও দলটি অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্তে অনড় থাকার কথা জানানো হয়েছে শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে কেউ কোনো ধরনের নির্বাচনে অংশ নিলে তাঁকে বহিষ্কার করা হবে বলে হুঁশিয়ারিও রয়েছে।

দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় উপনির্বাচনে অংশ নেওয়ায় দলটির প্রবীণ সদস্য ও পাঁচবারের সংসদ সদস্য উকিল আবদুস সাত্তারকে ইতোমধ্যে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। এই ঘটনার পর দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে দুইবার ভাবতে পারেন। তবে রাজনীতি যেহেতু সম্পূর্ণ সহজ বিষয় নয়, কিছু জটিলতা এখানে সবসময়ই থাকে। তাই বিএনপির সারাদেশে আরও এ রকম কতজন উকিল সাত্তার আছেন তা এখনই বলা যাচ্ছে না। সে জন্য কমিশন ঘোষিত ৫ সিটি নির্বাচনের মনোনয়ন যাচাই-বাছাইয়ের শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

এবারের ৫ সিটি নির্বাচন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৩ সালে একই দিনে চারটি সিটি নির্বাচনের ফলাফল। সেই সময়ে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট চার সিটিতেই বিএনপি সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থীরা জয়ী হয়েছিলেন। তাঁদের নিকটতম প্রার্থীরা সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী এবং নিজ নিজ সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ মেয়র ছিলেন। সেই সময়ে সরকারের শেষ সময়ের এ নির্বাচনের ফলাফলকে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ছায়া হিসেবে দেখা হয়েছিল। পরে ২০১৪-এর নির্বাচনে সেই সময়ের ফলাফল দেখেই নির্বাচনী কৌশল নির্ধারণ করেছিল আওয়ামী লীগ। এবারও সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাধ্যমে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের ছায়া দেখা যেতে পারে। তবে সেটা তখনই সম্ভব যখন নির্বাচন সুষ্ঠু হবে এবং বিএনপি এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে।

এটা ঠিক, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ৫ সিটির মধ্যে গাজীপুর, সিলেট ও বরিশালে তাদের দলীয় প্রার্থী হিসেবে নতুন মুখ এনেছে। তাতে করে দলটি নিজের ঘর থেকেই বিরোধিতার মুখে পড়লে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সেটা তাদের দলীয় ব্যাপার। প্রশ্ন হচ্ছে, এই নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি তাদের ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন’ কতটা এগিয়ে নিতে পারবে? এই আত্মজিজ্ঞাসা ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটিকে করতে হবে।

বড় প্রশ্ন, বর্তমান কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার যে প্রতিজ্ঞা বিএনপি করেছে, তাতে শেষ পর্যন্ত বিএনপি জয়ী হতে পারবে? বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সাম্প্রতিক বিভিন্ন বক্তব্যে এটা পরিষ্কার– বিএনপি দল গোছানো ও আন্দোলন জোরালো করায় মনোযোগী। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি কি তার দলের মধ্যে থাকা উকিল সাত্তারদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে? বিএনপি এখন যেভাবে বলছে তাদের চলমান আন্দোলন হচ্ছে– আগামীর বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ, সেই গণতন্ত্রকে হাতে ধরে সিটি নির্বাচনের সাঁকো পার হতে পারবে বিএনপি?

সাঁকো বিষয়ক একটি নীতিগল্প এখানে বলা যায়। এক ছোট্ট ছেলে তার বাবার সঙ্গে বেড়াতে বের হয়েছে। পথে এক সাঁকো দেখে ছেলেটি বলল, ‘বাবা, আমি ভয় পাচ্ছি। এই বাঁশের সাঁকো আমি পার হতে পারব না।’ ছেলেটির বাবা বললেন, ‘আমি আছি। তুমি ভয় পেয়ো না। তুমি এক হাত দিয়ে ওপরে বাঁশের রেলিংটা ধরো।’ তখন ছেলেটি বলল, ‘তবে বাবা আমি কিন্তু আরেক হাত দিয়ে তোমার হাত ধরব।’ এইবার ছেলেটির বাবা বললেন, ‘না এইভাবে নয়। তুমি আমার হাত ধরবে না। আমিই তোমার হাত ধরব।’ ছেলেটি অবাক হয়ে প্রশ্ন করে ‘কেন বাবা?’ তখন বাবা বললেন, ‘কারণ, সাঁকোর মাঝখানে ভয় পেয়ে তুমি আমার হাত ছেড়ে দিতে পারো। কিন্তু আমি কখনোই তোমার হাত ছাড়ব না।’

প্রায় সাড়ে চার দশক আগে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিএনপি এখন সবচেয়ে ক্রান্তিকাল পার করছে। টানা প্রায় ১৬ বছর রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি এখন আগামী নির্বাচনের ভেন্যুতে পৌঁছাতে আন্দোলনের যে ঝুঁকিপূর্ণ সাঁকো পার হতে চাইছে, সিটি করপোরেশন নির্বাচন সেখানে কতটা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে? বিএনপির হাত ধরে থাকা এই ৫ সিটি এলাকার নির্বাচনে আগ্রহী নেতাদের হাত বিএনপি শেষ পর্যন্ত শক্ত করে ধরে রাখতে পারবে তো? 

এহ্‌সান মাহমুদ: সহসম্পাদক, সমকাল