
ঈদ আসে আনন্দের বার্তা নিয়ে। এ বার্তাকে আরও বেশি আনন্দঘন করে তুলতে টিভি চ্যানেলগুলো নিয়ে আসে নানা রকম আয়োজন। এবারের ঈদেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তবে সেসব আয়োজন ঈদে কতটা বাড়তি আনন্দ যোগ করতে পেরেছে, এমন প্রশ্ন থেকেই যায়।
বলয়বন্দি নাটক-টেলিফিল্ম
সৃজনশীল কাজ সেটিই, যে কাজে চেষ্টা থাকে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার। যেহেতু নাটক-টেলিফিল্ম সৃজনশীল কাজ হিসেবে স্বীকৃত, অতএব নাট্যকার-নাট্যপরিচালকরা নিজেদের ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখবেন– এমন প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি। দর্শক হিসেবে এটি আমাদের অধিকারও বটে। কিন্তু ঈদের নাটক-টেলিফিল্ম দেখে মনে হলো, আমরা আমাদের অধিকার থেকে অনেকটাই বঞ্চিত। কারণ, ঈদে প্রচারিত সব নাটক-টেলিফিল্ম দেখা সম্ভব না হলেও যতগুলো দেখা সম্ভব হয়েছে, তাতে মনে হয়েছে কাজটিকে সৃজনশীল কাজ হিসেবে ধরা হয়নি। ধরা হয়েছে ফরমায়েশি কাজ হিসেবে। নাট্যকার অমুক অমুক থাকবেন, অভিনয়শিল্পী অমুক অমুক থাকবেন, পরিচালক অমুক অমুক থাকবেন– এই হলো ফরমায়েশি কাজের ধরন। মোট কথা, নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের কিছু একটি দাঁড়ালেই হলো।
যেন টেলিভিশনের ফাঁকা পর্দা কীভাবে ভরা হবে, সেই তৎপরতা। অথবা হাতে আসা বিজ্ঞাপনগুলোর ফাঁকে ফাঁকে কী প্রচার করা হবে, সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। ফলে দর্শক হিসেবে এটিই মনে হয়েছে, আমাদের নাটক-টেলিফিল্ম বন্দি হয়ে আছে একই বলয়ে। এসব নাটক-টেলিফিল্ম বানানোর ‘টার্গেট’ যেন ইউটিউব; টেলিভিশন নয়। কারণ, ইউটিউবে যাঁদের ভিউ বেশি, ঘুরেফিরে কেবল তাঁদেরই দেখা গেছে বড় বাজেটের নাটক-টেলিফিল্মগুলোতে। ফলে প্রথম বিরক্তি হিসেবে যা চোখে পড়েছে তা হচ্ছে– কমন মুখ। এটি প্রমাণ করেছে বা করছে আমাদের অভিনয়শিল্পীর সংখ্যা সীমিত; যা একটি দেশের নাট্যাঙ্গনের ‘গরিবি’ প্রকাশের জন্য যথেষ্ট। হ্যাঁ, ১০টি কাজ হলে দু-একটি তো ভালো এবং ব্যতিক্রম হয়ই। এবারের ঈদেও সেটি হয়েছে। তবে প্রযোজক, পরিচালকরা সচেতন হলে, বলয়বন্দি হয়ে না থাকলে ১০টি কাজের মধ্যে দু-একটি নয়, বরং সাত-আটটি ভালো হতে পারত। আমরা আশাবাদী, পরের ঈদে এ বলয়ের বাইরে কাজ হতে দেখব। দেখব নিরীক্ষাধর্মী কাজ। যেহেতু সৃজনশীলতা চর্চার পরিধি বাড়ার ক্ষেত্রে এমন সব কাজ আবশ্যক।
দায়সারা তারকা আড্ডা
তারায় তারায় খচিত থাকার কথা ছিল তারকা আড্ডা। তবে কি খচিত ছিল না? এ প্রশ্নের জবাবে জোর দিয়ে বলা যায়, অবশ্যই ছিল। নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য তারকারাই উপস্থিত ছিলেন ঈদের আড্ডাগুলোতে। তবে কোথায় যেন ঘাটতি, কোথায় যেন একঘেয়েমি, কোথায় যেন দায়সারা ভাব। আরেকটি ব্যাপার। আপনি যদি টেলিভিশন মিউট করে এসব অনুষ্ঠান দেখেন, মনে হবে দুর্দান্ত। কিন্তু যেই স্বাভাবিক আওয়াজে শুনবেন, শুরু হবে অস্বস্তি। কারণ, আপনার কানে আসবে উপস্থাপকের সেই বস্তা পচা প্রশ্ন– ঈদে আপনার প্রিয় খাবার কী? ছোটবেলার ঈদ আর বড়বেলার ঈদের মধ্যে পার্থক্য কী? ছোটবেলার ঈদের কোনো মজার স্মৃতি কি মনে পড়ে? এবার একটি উদাহরণ দিই। একটি টিভি চ্যানেলে আমাদের চলচ্চিত্রের একজন তারকার সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। ঈদের চতুর্থ দিন রাতে। উপস্থাপক প্রশ্ন করলেন– ‘অ্যাজ এন অ্যাক্টর হিসেবে আপনার বক্তব্য কী?’ আমার পাশেই বসা ছিলেন একজন। তিনি হেসে উঠলেন। বললেন ‘অ্যাজ’ বলার পর আবার ‘হিসেবে’? ঈদের অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছেন অথচ এইটুকু জানেন না?
আসলে কে কতটুকু জানেন, সেটি খোঁজা আমাদের দায়িত্ব নয়। তবে পর্দায় কী বলবেন বা করবেন, সেটি আমরা খুঁজতেই পারি। এ নিয়ে কথা বলতেই পারি। কারণ, পর্দাটা আমাদের মতো সাধারণ দর্শকের জন্যই। ঈদ আয়োজনগুলো তো অবশ্যই। আরেকটি বিষয়, ঈদের তারকা আড্ডাগুলোকে যতটুকু না তারকা আড্ডা মনে হয়েছে, এর চেয়ে বেশি মনে হয়েছে নিজের কাজের প্রচারণা। কারণ, সিনেমার অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে তারকা আড্ডায় আমরা বারবার তাঁদের মুখই দেখেছি, ঈদে যাঁদের সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। ব্যাপারটা অনেকটা এমন– দু’পক্ষেরই উপকার হলো। সহজে তারকাদের পেয়ে চ্যানেলগুলো উপকৃত হলো, আর তারকারা উপকৃত হলেন ঈদ আড্ডার নামে টিভি পর্দায় নিজেদের সিনেমার প্রচারণা চালাতে পেরে। কিন্তু দু’পক্ষ যে উপকৃত হলো, পক্ষ তো আরেকটি আছে– দর্শক পক্ষ। সেই পক্ষ কতটুকু উপকৃত হলো? চ্যানেল কর্তৃপক্ষ এ প্রশ্নের উত্তর আদৌ খুঁজেছে কি? না খুঁজে থাকলে আগামীতে যেন খোঁজে। নইলে টিভিও থাকবে, তারকাও থাকবেন; শুধু থাকবেন না টিভির সামনে বসার মতো মানুষ।
পুরোনো আয়োজনের ছড়াছড়ি
আগে ঈদের অনুষ্ঠান হতো সাত দিনব্যাপী। এখন কোনো কোনো টিভি চ্যানেল ১০ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানও করে। ১০ দিন কেন, ১৫ দিনব্যাপী করুক, এক মাসব্যাপী করুক; তাতে দোষের কিছু দেখি না। সামর্থ্য থাকলে অবশ্যই করবে। কিন্তু সামর্থ্য না থাকলেও যদি করতে যায়, তাহলে নিন্দা সহ্য করতেই হবে। দর্শক অপেক্ষায় থাকেন ঈদে নতুন নতুন নাটক, নতুন নতুন নৃত্যানুষ্ঠান, নতুন নতুন তারকা আড্ডা দেখার জন্য। কিন্তু যদি দেখেন নতুনের সঙ্গে কিছু পুরোনো অনুষ্ঠানও চালিয়ে দেওয়া হয়েছে, তখন বিরক্তির উদ্রেক না হয়ে পারে? বলতে দ্বিধা নেই, এবার পুনঃপ্রচারের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। যেসব নাটক প্রচার হয়েছে এক-দেড় বছর আগে, যেগুলো এক-দেড় বছর ধরেই ইউটিউবে আছে; সেসব নাটক প্রচার করেছে অনেক চ্যানেলই।
বোঝা গেছে, তাদের সেই পরিমাণ নতুন নাটক বা অনুষ্ঠান ছিল না, যে পরিমাণ নাটক বা অনুষ্ঠান থাকলে সাত-আট দিনব্যাপী ঈদ আয়োজন চালিয়ে নেওয়া যায়। তবু ঘোষণা যেহেতু দেওয়া হয়ে গেছে, কী আর করা! চালাও পুরোনোগুলোই। কিন্তু কেন? ঈদ তো পুরোনো অনুষ্ঠানের জন্য না। আপনাদের যদি সামর্থ্য না থাকে, সাত-আট দিন বা চার-পাঁচ দিনব্যাপী অনুষ্ঠান আয়োজনের, তাহলে কমাতে কমাতে এক দিন বা দু’দিনে নামিয়ে নিয়ে আসুন। ক্ষতির তো কিছু দেখছি না! দরকার কী দর্শকের সঙ্গে চালাকি করার? নাকি আপনারা ধরেই নিয়েছেন আপনাদের চ্যানেল কেউ দেখে না? যেহেতু দেখেই না, অতএব নতুন কী আর পুরোনোই বা কী! আমাদের অনুরোধ থাকবে, চ্যানেলগুলো যেন আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। যেন বিশ্বাস করে, দর্শক তাদের দেখে। তাতে ঈদ আয়োজনে পুরোনো অনুষ্ঠান প্রচারের আগে ১০ বার ভাববে। এটিই হওয়া উচিত। নইলে এখনও যাঁরা ঈদ উপলক্ষে টিভির সামনে বসেন, তাঁরা আর বসবেন না। ভাববেন, পুরোনো অনুষ্ঠান দেখে সময় অপচয়ের কোনো মানে হয় না।
ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ও অন্যান্য
বিটিভির ঐতিহ্যবাহী ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘আনন্দ মেলা’ বরাবরের মতো এবারও ছিল বর্ণাঢ্য এবং তারকাবহুল। এবারের আয়োজনের উল্লেখযোগ্য দিক ছিল, এর আগে যাঁরা এ অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছিলেন, তাঁদের প্রায় সবার উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে– যা অনুষ্ঠানটিকে শুধু বর্ণাঢ্যই করেনি, করেছে স্মৃতিময়ও। বিটিভির আরেক ঐতিহ্যবাহী ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র পরিবেশনাও ছিল জাঁকজমকপূর্ণ। দর্শক-বিনোদনের পর্যাপ্ত আয়োজন ছিল এই অনুষ্ঠানে। ঈদে সিনেমা দেখার অভ্যাস আমাদের বহু বছরের। তবে নানা কারণে এখন সেভাবে সিনেমা হলে যাওয়া হয় না। টিভি পর্দায়ই খোঁজা হয় সিনেমার বিনোদন।
চ্যানেল আই প্রতি ঈদের মতো এবারের ঈদেও বেশ কিছু নতুন সিনেমা দেখিয়েছে। নতুন সিনেমা দেখিয়েছে দীপ্ত টিভিও। কিন্তু অন্যান্য চ্যানেলে প্রচারিত সিনেমাগুলো আমাদের অবাকই করেছে বলা চলে। কারণ, সারা বছর যেসব সিনেমা তারা প্রচার করে, সেগুলো প্রচার করেছে বড় বড় কোম্পানির টাইটেল স্পন্সর নিয়ে। তো যে সিনেমা আমি টিভি পর্দায় ঈদ ছাড়াই একশবার দেখে ফেলেছি, সেই সিনেমা আবার ঈদে কেন দেখব? লম্বা লম্বা বিজ্ঞাপন বিরতি দেখার জন্য? আর লম্বা বিজ্ঞাপন বিরতি দিতে গিয়ে সিনেমা কেটে ছোট করে আপনারা যে একটি সিনেমার গল্পকে বিকৃত করে উপস্থাপন করছেন দর্শকের সামনে, এতে যে সিনেমার গল্প সম্পর্কে দর্শকমনে বিরূপ ধারণা তৈরি হচ্ছে, সেই খেয়াল আছে আপনাদের? খেয়াল থাকলে ভালো। যদি না থাকে এবং দর্শক-খরা চরমে পৌঁছে, তাহলে দায়ভার আপনাদেরই নিতে হবে। সেটি প্রত্যক্ষভাবে হোক আর পরোক্ষভাবেই হোক।
মন্তব্য করুন