আজ বিশ্ব মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিবস। ২০১৪ সাল থেকে আন্তর্জাতিকভাবে দিবসটি পালিত হলেও বাংলাদেশে এ বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। অথচ মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা একজন নারীর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর একটি। কৈশোরকাল থেকেই এ বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টি হওয়াটা জরুরি। কৈশোরকাল ভয়ভীতিহীন আনন্দে চলার বয়স। কিন্তু এ সময়েই কিশোরীরা কতগুলো রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হন। কিছু ট্যাবু ও কুসংস্কার তাঁদের এ সময়টাকে বিষাদময় করে তোলে। বয়ঃসন্ধিকালে পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁদের মাঝে শারীরিক, মানসিক ও আচরণগত কিছু স্বাভাবিক পরিবর্তন আসে; যা সমাজের মানুষের কাছে অস্বাভাবিক ঠেকে।

দেশের একটি বড় অংশ কিশোরীদের এ সময়কে বুঝতে বা জানতে চেষ্টা করে না। আর এখান থেকেই একজন নারীর জীবনে শুরু হয় ভয়ের সংস্কৃতি।

বয়ঃসন্ধিকালে একজন কিশোরী জীবনের প্রথম মাসিকের অভিজ্ঞতা লাভ করেন। সাধারণত ১১-১৪ বছর বয়সের যে কোনো সময় একজন কিশোরীর
মাসিক বা ঋতুস্রাব হতে পারে, যা প্রায় ৪৯ বছর পর্যন্ত চলতে পারে। কিন্তু আমাদের সমাজে মাসিক নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনা হয় না, মাসিককে লজ্জার বিষয় হিসেবে ধরা হয় এবং শিক্ষিত সমাজের অনেকেও পিরিয়ডসংক্রান্ত আলোচনা এড়িয়ে যান। ফলে একজন কিশোরী হঠাৎ করেই যখন জামা-কাপড়ে রক্তের উপস্থিতি দেখেন, তখন আতঙ্কিত হয়ে পড়েন, নিজেকে গুটিয়ে নেন। হাস্যোজ্বল মেয়েটি রাতারাতি হয়ে যান গৃহবন্দি। পরিবার বা প্রতিষ্ঠান যেহেতু এ বিষয়ে তাঁকে কোনো শিক্ষা দেয়নি, তাই এমন পরিস্থিতিতে তিনি অসহায় হয়ে পড়েন। কার কাছে কী বলবেন, কীভাবে বলবেন– তা বুঝে উঠতে পারেন না। ফলে মাসিকের সময় কীভাবে নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, ব্যবহার্য উপকরণ ও খাদ্যতালিকা কী হবে– এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে তিনি থাকেন একেবারেই অজ্ঞ।

ইয়ুথ প্ল্যানেটের নিজস্ব সমীক্ষায় আমরা দেখেছি,বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের প্রায় ৯৮ শতাংশ পরিবারের অভিভাবকরা সন্তানদের সঙ্গে মাসিক নিয়ে কোনো উন্মুক্ত আলোচনা করেন না। আমাদের প্রকল্প অঞ্চলের প্রায় ২০০০ নারী ও কিশোরীর ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছি, মাত্র ১০-১২ শতাংশ মাসিকের সময় স্যানিটারি প্যাড বা স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে কাপড় ব্যবহার করেন। বেশিরভাগ নারীরা পুরোনো কাপড় ব্যবহার করেন কোনো ধরনের স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই। এমনকি অধিকাংশ নারীদের মাঝে মাসিক নিয়ে রয়েছে বিস্তর কুসংস্কার।

মাসিকের সময় একজন কিশোরী যখন বিষণ্নতায় ভোগেন, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়,তার মনে অকারণ দুঃখবোধ বা হতাশা কাজ করে– সেগুলোকেও ভালো চোখে দেখে না এ সমাজ। তিন বছর আগে ইয়ুথ প্ল্যানেটের মাধ্যমে আমরা যখন গ্রামীণ নারীদের সঙ্গে মাসিককালীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে আলোচনার উদ্যোগ নেই, তখন নানা ধরনের কটাক্ষের শিকার হয়েছি।

নানা প্রতিকূলতার মাঝেও আমরা কর্মসূচি বন্ধ করিনি। মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়েছি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়েছি এবং আজ আমাদের প্রকল্প এলাকাতে এটি স্বাভাবিক আলোচনায় পরিণত হয়েছে। তা ছাড়া ২০২২ সালে ‘জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড’ লাভের পর আমাদের সংগঠনের কাজের বিরুদ্ধে মৌলবাদী গোষ্ঠীর অপতৎপরতাও অনেকটা কমে গেছে। এখন আগের চাইতে অনেক ভালোভাবে কাজ করা যাচ্ছে।

চ্যালেঞ্জ এখনও রয়ে গেছে। আমাদের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে ইয়ুথ প্ল্যানেট ১০ লাখ নারীর কাছে পৌঁছাবে। আমরা মনে করি, নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষা কারিকুলাম সাজানো উচিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্র নারীবান্ধব করার পাশাপাশি মাসিক নিয়ে সমাজের ট্যাবুগুলো ভাঙার উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। মাসিক নিয়ে কুসংস্কার দূর করার দায়িত্ব একা সরকারের নয়। এ দায়িত্ব আমার, আপনার, আমাদের সবার।