ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

কিশোরীদের শিক্ষায় ঋতুস্রাবের প্রভাব

কিশোরীদের শিক্ষায় ঋতুস্রাবের প্রভাব

 আব্দুল জব্বার তপু

প্রকাশ: ২৮ মে ২০২৩ | ০৯:২৮ | আপডেট: ২৮ মে ২০২৩ | ০৯:২৮

ঋতুস্রাব কিশোরীসহ সব প্রাপ্তবয়স্ক নারীর স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা আমাদের সমাজে ‘মাসিক’,  ‘পিরিয়ড’, ‘মেন্স’ প্রভৃতি নামে পরিচিত। মূলত কোনো নারীর নিয়মিত মাসিক হওয়ার অর্থ হলো, তিনি গর্ভধারণের জন্য সক্ষম। একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর প্রতি মাসেই একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য (সাধারণত ৩-৭ দিন) মাসিক হয়ে থাকে। অর্থাৎ একজন প্রাপ্তবয়স্ক কিশোরী বা প্রাপ্তবয়স্ক নারীর বছরে ৩৯-৯১ দিন মাসিক হয়।

মাসিক একটি স্বাস্থ্যগত বিষয় হলেও, কিশোরীদের শিক্ষায় এর প্রভাব রয়েছে। সামাজিক কুসংস্কার, স্কুলে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবস্থা না থাকাসহ নানা কারণে কিশোরীদের অনেকেই তাদের মাসিক চলাকালে স্কুলে যেতে চায় না। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন সার্ভে ২০১৮-এর তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৩০ শতাংশ কিশোরী মাসিক চলাকালে স্কুলে যায় না। ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র আইসিডিডিআর,বি কর্তৃক পরিচালিত আরেকটি গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৪১ শতাংশ কিশোরী তাদের মাসিকের সময় স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। তারা মাসিকের কারণে গড়ে প্রতি মাসে ২.৮ দিন স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। পাশাপাশি ২০১৭ সালে বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলায় পরিচালিত সার্ভের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৫৪ শতাংশ কিশোরীই স্কুলে থাকাকালে নিজেদের মাসিক ব্যবস্থাপনায় আত্মবিশ্বাসী থাকে না।

বাংলাদেশে ২০২২ সালে পরিচালিত জনশুমারি ও গৃহগণনার তথ্য অনুযায়ী, নারীদের সাক্ষরতার হার ৭২ শতাংশেরও বেশি; যা ২০১১ সালে ছিল প্রায় ৪৯ শতাংশ, যা থেকে বোঝা যায় যে  বাংলাদেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ দিন দিন বাড়ছে। এ ছাড়া বর্তমানে শিক্ষা ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণও প্রায় সমান সমান। ২০২২ সালের এসএসসি-সমমানের পরীক্ষায় অংশ নেয় ১৯ লাখ ৯৪ হাজার ১৩৭ জন শিক্ষার্থী; যার মধ্যে ছেলে ৯ লাখ ৯৮ হাজার ১৯৩ জন ও মেয়ে ৯ লাখ ৯৫ হাজার ৯৪৪ জন।

বয়ঃসন্ধিকালীন কিশোরীদের মাসিক-সংক্রান্ত অভিজ্ঞতার পরিবর্তন; শারীরিক স্বাস্থ্য, মানসিক স্বাস্থ্য, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে মাসিক-সংক্রান্ত অভিজ্ঞতাগুলো পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে জানার লক্ষ্যে ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়ার গবেষণা সংস্থা বার্নেট ইনস্টিটিউট, ওয়াটার এইড বাংলাদেশ ও তাদের সহযোগী পার্টনার নবলোক পরিষদ, খুলনার যৌথ উদ্যোগে খুলনা সিটি করপোরেশন এলাকা ও ডুমুরিয়া উপজেলার মাধ্যমিক স্তরের ১০১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত কিশোরীদের অংশগ্রহণে একটি লংগিচুডিনাল কোহর্ট স্টাডি বা দীর্ঘমেয়াদি কোহর্ট গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে। গবেষণাটিতে সহ-শিক্ষা বিদ্যালয়, বালিকা বিদ্যালয় ও মাদ্রাসায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া ২০১৬ জন কিশোরী অংশগ্রহণ করছে; যাদের একাধিকবার ফলোআপ সার্ভেতে অংশগ্রহণের জন্য আমান্ত্রণ জানানো হবে। গবেষণাটি ২০২২ সালে শুরু হয়েছে ও ২০২৫ সাল নাগাদ শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

২০২২ সাল ছিল এ গবেষণা প্রকল্পটির প্রস্তুতি পর্ব। যেখানে সিচুয়েশন অ্যানালাইসিস বা বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ এবং প্রশ্নপত্রগুলো কনটেক্সচুয়ালাইজেন বা প্রাসঙ্গিকীকরণের লক্ষ্যে একটি কোয়ালিটেটিভ গবেষণা ও পাইলট সার্ভে পরিচালিত হয়। কোয়ালিটেটিভ গবেষণায় কিশোরীদের পাশাপাশি তাদের অভিভাবক, শিক্ষক-কিশোরদের একান্ত ও দলীয় সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। পাইলট সার্ভেতে ৩৬০ জন কিশোরী অংশগ্রহণ করে। পাইলট সার্ভের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সর্বশেষ মাসিক চলাকালীন প্রায় ৪৪ শতাংশ কিশোরী অন্তত এক দিন স্কুলে অনুপস্থিত ছিল, ৫১ শতাংশ কিশোরী মাসিক চলাকালে সাধারণত স্কুলে অনুপস্থিত থাকে এবং ৪০ শতাংশ কিশোরী মনে করে, মাসিক চলাকালে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া উচিত নয়।

মাসিক চলাকালে কিশোরীদের স্কুলে না যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ, স্কুলে মাসিক ব্যবস্থাপনার জন্য উপযুক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট সুবিধা না থাকা। গবেষণা কার্যক্রম চলাকালে স্কুলে মেয়েদের জন্য ব্যবহৃত টয়লেটগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, অধিকাংশ টয়লেটেই ঝুড়ি নেই, কিছু কিছু টয়লেটে ঝুড়ি থাকলেও তাতে ঢাকনা নেই। পাইলট সার্ভেতে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, মাসিক চলাকালে যারা স্কুলে যায় তাদের ৬৯ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী স্কুলে থাকাকালে মাসিকের প্যাড বা কাপড় পরিবর্তন করে না। তারা বাড়িতে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে (৬০ শতাংশ) ও বাসায় গিয়ে পরিবর্তন করে আসে (৯ শতাংশ); যদিও তারা ৬-৮ ঘণ্টা স্কুলে অবস্থান করে। কারও কারও বাসায় যাওয়া-আসার সময়সহ যা ৮-১০ ঘণ্টা হয়ে থাকে। যেখানে চিকিৎসকদের পরামর্শ হলো, প্রতি ৪-৬ ঘণ্টা পরপর মাসিকের জন্য ব্যবহৃত উপকরণ (প্যাড বা কাপড়) পরিবর্তন করা জরুরি।

মাসিক চলাকালে কিশোরীদের স্কুলে না যাওয়ার আরেকটি অন্যতম কারণ হলো, নানা ধরনের সামাজিক কুসংস্কার। মাসিক চলাকালে বাইরে যাওয়া যাবে না, বাইরে গেলে খারাপ হাওয়া লাগবে, মেয়ের মাসিক হয়েছে তা অন্য কেউ জানলে জাদুটোনা করবে, মাসিকের রক্ত অন্য কেউ দেখলে সন্তান ধারণে সমস্যা হবে, মাসিকের ব্যথা কমানোর জন্য কোনো ধরনের মেডিকেশন বা ওষুধ খাওয়া যাবে না তাহলে পরে সমস্যা হবে, মাসিক একটি গোপনীয় ব্যাপার, এটা কোনোভাবেই কাউকে জানতে দেওয়া যাবে না প্রভৃতি কুসংস্কার আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে। এসব কুসংস্কার মাসিক চলাকালে কিশোরীদের স্কুলে না যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া শারীরিক অসুস্থতা, ক্লাসে মনোযোগ দিতে না পারা, ক্লাস টিচারের কাছে টয়লেটে যাওয়ার অনুমতি নিতে লজ্জা পাওয়া, মাসিকের কাপড়, প্যাড বা কাপড় লিক হয়ে যাওয়া ও তা দেখে অন্যদের কাছে উত্ত্যক্ত হওয়ার ভয় প্রভৃতি কারণে কিশোরীরা মাসিক চলাকালে স্কুলে যায় না বলে কিশোরীরা জানায়।

শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেলেও কিশোরীদের নিয়মিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে মাসিক স্বাস্থ্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। স্কুলে মাসিক ব্যবস্থাপনায় উপযুক্ত পরিবেশ না থাকা, কখনও সামাজিক কুসংস্কার বা শারীরিক অসুস্থতা, নানা কারণে কিশোরীরা প্রতি মাসেই তাদের মাসিক চলাকালে স্কুলে যাওয়া থেকে বিরত থাকছে। বছরের একটা বড় সময় (৩৯-৯১ দিন) তারা স্কুলে অনুপস্থিত থাকায় স্বাভাবিকভাবেই তাদের পড়ালেখা বিঘ্ন ঘটছে। ফলে বছর শেষে কেউ তার যোগ্যতা অনুযায়ী ফলাফল পাচ্ছে না, কারও কারও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পেরে হয়তো স্কুলে যাওয়াই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বা কেউ বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে।

সময় এসেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার উপকরণ সরবরাহের পাশাপাশি মাসিক ব্যবস্থাপনার উপকরণ সরবরাহ ও মাসিক ব্যবস্থাপনার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করার। পাশাপাশি মাসিক-সংক্রান্ত সামাজিক কুসংস্কার ভেঙে বিজ্ঞান সম্মত জ্ঞান সাধারণ জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার। সময় এসেছে মা ও শিশু স্বাস্থ্যের পাশাপাশি কৈশোরকালীন কিশোরীদের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনগুলো নিয়ে সর্বমহলে গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করার। অন্যথায় আমাদেরই কারও কন্যা বা কারও বোন নীরবে-নিভৃতে শারীরিক ও মানসিক বিপর্যস্ত হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে পড়বে।

আরও পড়ুন

×