- চতুরঙ্গ
- দুই সন্তানকে বাঁচাতে আগুনে ঝাঁপ মায়ের
দুই সন্তানকে বাঁচাতে আগুনে ঝাঁপ মায়ের
তিনজনেরই মর্মান্তিক মৃত্যু

প্রতীকী ছবি
বাঁশের বেড়ার ঘরে আগুন দেখে প্রথমে বাইরে এসে চিৎকার করে আশপাশের মানুষের সাহায্য চেয়েছিলেন নুর নাহার বেগম। কারণ, ঘরের ভেতরেই ছিল তাঁর কলিজার টুকরা দুই সন্তান। এ অবস্থায় ধৈর্য ধরা যে কোনো মায়ের জন্যই কার্যত অসম্ভব। তাই অন্যরা এগিয়ে আসার আগেই দুই সন্তানকে উদ্ধার করতে জ্বলন্ত ঘরে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। তবে সন্তানদের রক্ষা করতে পারেননি তিনি। সন্তানদের সঙ্গে আগুনে পুড়ে নিজেও জীবন দিয়েছেন।
শনিবার রাত সাড়ে ৪টার দিকে চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ থানার সৈয়দপাড়ায় এ হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে। গতকাল রোববার দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) লাশ ঘরে গিয়ে ৩০ বছর বয়সী নুর নাহারের পাশে তাঁর ছোট ছেলে মারুফ ও মেয়ে ফারিয়ার নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। মারুফের বয়স এক আর ফারিয়ার বয়স তিন বছর। অন্য ঘরে থাকায় বেঁচে গেছে নুর নাহারের আরেক সন্তান। চমেকের লাশ ঘরের সামনে কথা হয় নুর নাহারের ভাগনে মো. আমিনের সঙ্গে। তাঁরা পাশাপাশি থাকেন। আমিন বললেন, ‘খালার আগুন আগুন চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায়। আমি, মা, স্ত্রী-সন্তানসহ চারজন লাফ দিয়ে উঠে বাইরে বের হয়ে আসি। তখন খালাকে আগুন নেভাতে চিৎকার করতে দেখি। সঙ্গে সঙ্গে বালতির পানি দিয়ে আগুন নেভাতে শুরু করি। খালা কোন ফাঁকে আগুন লাগা ঘরে ঢুকে যান টের পাইনি। খালা তাঁর ঘুমন্ত দুই সন্তানকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেও পুড়ে মারা গেছেন। খালা ছেলেমেয়েকে আনতে না গেলে জীবিত থাকতেন। মায়েরা এমনই হন।’
বায়েজিদের পূর্ব শহীদনগর সৈয়দপাড়ার স্থানীয় বাসিন্দা দেলোয়ারের ছয়টি বাঁশের বসতঘরের মধ্যে দুটি ঘর আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তিনটি ঘরের আংশিক পুড়ে গেছে। এ ঘরগুলো দরিদ্র দেলোয়ার তাঁর অসচ্ছল ছয় মেয়ের বসবাস করার জন্য তৈরি করে দেন। সেই বাঁশের বেড়ার ঘরে বসবাস করে আসছিলেন ছয় বোন ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা।
নুর নাহারের ঘরে রান্নার জন্য আনা নারকেল পাতার স্তূপ ছিল। তার পাশেই মশার কয়েল জ্বালিয়ে ঘুমাতে যান তাঁরা। মশার কয়েল থেকে নারকেল পাতার স্তূপে আগুন লেগেই ছড়িয়ে পড়েছে বলে ধারণা করছেন নিহতের স্বজন। তাঁর বোন আয়েশা বেগম বলেন, সে তিন সন্তানকে নিয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটাচ্ছিলেন। তার স্বামী গাড়িচালক। তবে নেশাগ্রস্ত হওয়ায় ঠিকমতো স্ত্রী-সন্তানের খবরও নিতেন না। আমরা বোন ও ভাইয়েরা নুর নাহার ও তার সন্তানদের দেখাশোনা করতাম।
ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া নূর নাহারের সাড়ে পাঁচ বছর বয়সী সন্তান মাসুদ বলে, ‘খালা আমার মা কই? আমি মার কাছে যাব। ভাইবোনদের এনে দাও।’ আগুন লাগার খবর শুনে সকাল থেকে বাড়িটিতে আশপাশের প্রচুর মানুষ আসা-যাওয়া করছেন।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে স্ত্রী ও দুই সন্তানের মৃত্যুর খবর পেয়ে চমেক হাসপাতালে ছুটে যান নুর নাহারের স্বামী মো. মানিক। হাসপাতালে কিছুক্ষণ থাকার পর চলে যান তিনি। নুর নাহারের ভাগনে মো. বেলাল জানান, আগুন লাগার সময় বাসায় মানিক ছিলেন না। সে বাসায় থাকলে আজ খালা ও দুই ভাইবোনকে হারাতে হতো না। তাঁদের মৃত্যুর খবর পেয়ে এসে কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে চুপচাপ চলে গেছেন। লাশগুলো নেওয়ার প্রয়োজনও মনে করেননি।
চমেক হাসপাতালে বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের প্রধান ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, আগুনে দগ্ধ তিনজনের শ্বাসনালিসহ শরীরের প্রায় ৯০ শতাংশ পুড়ে যায়। তাঁদের মধ্যে মারুফকে হাসপাতালে আনার সঙ্গে সঙ্গে এবং নুরু নাহার ও ফারিয়া সকাল সাড়ে ১১টার দিকে মারা যান। বায়েজিদ ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার কামরুজ্জামান বলেন, আগুন নেভানোর পর বাড়িতে দুটি সিলিন্ডার অক্ষত পেয়েছেন। তাঁদের ধারণা, মশার কয়েল থেকে আগুন লেগেছে।
মন্তব্য করুন