ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির মাঠের রাজনীতিতে দলটির কেন্দ্রীয় নেত্রী নিপুণ রায় চৌধুরী পরিচিত মুখ। লাল পাড়ে সাদা শাড়ি, কপালে লাল টিপ, কখনও কখনও রোদচশমা চোখে তাঁকে মিছিলের সামনের সারিতে দেখা যায় সংবাদমাধ্যম বা সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে। তবে গত ২৬ মে দেখা গেছে ভিন্ন দৃশ্য। নেতাকর্মী পরিবেষ্টিত নিপুণ মাথায় একটি সাদা কাপড় চেপে ধরে চিৎকার করছেন। তাঁর কপাল গড়িয়ে রক্তধারা নেমে আসছে। গত শুক্রবার বুড়িগঙ্গার ওপারে কেরানীগঞ্জের জিনজিরা এলাকায় বিএনপির ঢাকা জেলার পূর্বনির্ধারিত সমাবেশ ছিল। অভিযোগ উঠেছে, সমাবেশে স্থানীয় আওয়ামী লীগ হামলা করেছিল। তখনই তাঁর মাথায় ইটের আঘাত লাগে।

সমকাল প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে, ওই সমাবেশকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাকর্মীর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় পরে নিপুণ রায় চৌধুরীসহ বিএনপির ৫ শতাধিক নেতাকর্মীর নামে মামলা হয়েছে। শনিবার কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় দায়েরকৃত মামলার এজাহারে আওয়ামী লীগ অফিস ভাঙচুর ও নেতাকর্মীর ওপর হামলার অভিযোগও আনা হয়েছে। পরে অবশ্য তিনি মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে হাইকোর্টে গিয়ে ওই মামলায় তিন মাসের জন্য জামিন পেয়েছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, প্রথমে হামলার শিকার এবং পরে মামলায় আসামি হওয়ার মতো ‘শাঁখের করাত’ বিএনপির মতো একটি রাজনৈতিক দল কীভাবে মোকাবিলা করবে? নিপুণ রায় চৌধুরী ব্যক্তিগত ও পারিবারিকভাবে আমাদের সামাজিক বাস্তবতায় ‘অসাধারণ’ রাজনৈতিক নেতা। তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ শাখার সভাপতি। আরও পরিচয় আছে। তিনি দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের পুত্রবধূ এবং ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরীর মেয়ে। তাঁরই যখন এই অবস্থা; কেরানীগঞ্জের ওই মামলায় বাকি পাঁচ শতাধিক ‘সাধারণ’ নেতাকর্মীর কী হবে?

যেমন সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমসূত্রে আরও জানা গেছে, আওয়ামী লীগ অফিস ভাঙচুর ও নেতাকর্মীর ওপর হামলায় কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে যে ‘অজ্ঞাত’ পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে, তাদের মধ্যে ৯ জনকে শুক্রবার রাতেই অভিযান চালিয়ে আটক করে পুলিশ। পরদিন তাঁদের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়। তাঁদের কতজন হাইকোর্টে গিয়ে জামিন নেওয়ার সামর্থ্য রাখে? সাধারণ নেতাকর্মী অনেকের অর্থনৈতিক ও পারিবারিক পরিস্থিতিও নাজুক। তাঁরা কোথায় যাবেন? সভা-সমাবেশ করার গণতান্ত্রিক অধিকার তাঁরা কি ভোগ করবেন না?
রাজনৈতিক দাবি আদায়ে সভা-সমাবেশ এই দেশে অন্যান্য আমলেও হয়েছে, এখনও হচ্ছে। বিরোধীদের সভার অনুমোদন দিতে আগেও ক্ষমতাসীনরা নানা কারসাজি ও চাতুরীর আশ্রয় নিত। কিন্তু বর্তমানে যেভাবে বিরোধীদের সমাবেশ ঘিরে ক্ষমতাসীনদের তৎপরতা; এর নজির খুব বেশি নেই। সমাবেশের আগের রাতে গ্রেপ্তার, সমাবেশের দিন ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন দিয়ে একই স্থানে বা কাছাকাছি স্থলে পাল্টা সমাবেশ আহ্বান, সমাবেশের মাঝামাঝি সময়ে হামলা; সব শেষে মামলা। বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ ঘিরে এই চিত্র এখন সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা পলিসির ঘোষণা দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘সহিংসতার মাধ্যমে জনগণকে সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার প্রয়োগ করতে বাধা দেওয়া হলে মার্কিন ভিসা পলিসি ব্যবহার করা হবে।’ কিন্তু ইতোমধ্যে খাগড়াছড়ি, কেরানীগঞ্জ, খুলনা, পটুয়াখালী, নাটোর, যশোরসহ বেশ কিছু জায়গায় বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে বাধা ও হামলার ঘটনা ঘটেছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একে অপরকে শারীরিকভাবে আঘাত কাম্য নয়। বিশেষত একজন নারীকে আঘাত আমাদের দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মানদণ্ডেও অগ্রহণযোগ্য।  
সর্বোপরি, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির দলীয় কর্মসূচি পালনের অধিকার থাকবে না? কিন্তু সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী বিরোধী দলের রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্নে ক্রমবর্ধমান হারে অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছেন। বেশকিছু ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করতে দেখা যাচ্ছে। বিএনপির সভা-সমাবেশে এভাবে আক্রমণ, তারপর মামলা ও আটক কোনো বিবেচনাতেই সমর্থনযোগ্য নয়। এমনকি আহত নেতাকর্মী বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। কারণ সরকারি হাসপাতালে গেলে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

দেশে সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করতে হলে ক্ষমতাসীনদেরই এগিয়ে আসতে হবে। তাদেরই সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে। সরকার মুখে যতই বলুক– দেশে ভিন্নমত বা বিরোধী রাজনীতিচর্চার উপযোগী পরিবেশ আছে; শুক্রবারের ঘটনাটি প্রমাণ করে বাস্তবে তা কতটা। বিরোধীদের সভা-সমাবেশে হামলা এবং হামলার পরে মামলা কোনো সুস্থ রাজনৈতিক কৌশল হতে পারে না। অতীতে অনেকবার দেখা গেছে, ভিন্নমতকে দমন করতে চরমপন্থা অবলম্বন করলে আখেরে সেটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই ব্যাহত করে। আওয়ামী লীগের মতো একটি প্রাচীন ও অভিজ্ঞ রাজনৈতিক দলের সেটা ভুলে যাওয়া উচিত হবে না।

এহ্সান মাহমুদ: সহসম্পাদক, সমকাল