গত ১৪ আগস্ট মুক্তি পেয়েছে ‘বিলিয়ন ডলার হাইস্ট’ শিরোনামের প্রামাণ্যচিত্রটি। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকিংয়ের ঘটনাকে কেন্দ্রে রেখে এই প্রামাণ্যচিত্রে মূলত আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সাইবার অপরাধ কত ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে সেই বার্তাটিই হয়তো দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ইউনিভার্সাল পিকচার্স ও জিএফসি ফিল্মের ব্যানারে নির্মিত এই প্রামাণ্যচিত্রের কারণেই আবারও বাংলাদেশের গণমাধ্যমে আলোচনায় এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকিংয়ের দুর্ঘটনাটি। আসাটাই হয়তো স্বাভাবিক।

কেননা বিচারাধীন বিষয় নিয়ে দায়িত্বশীল অংশীজনরা জনপরিসরে মন্তব্য কম করলেও জনপ্রিয়তা-নির্ভর মূলধারার গণমাধ্যমে এমন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলবেই। সেটা বন্ধ করতেই হবে- এমনও নয়। তবু ইতিবাচক বা নেতিবাচক যে কোন প্রচারণা থেকেই আয় করতে সক্ষম- এমন গণমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনার ক্ষেত্রেও দায়িত্বশীলতার পরিচয় রাখা চাই।

এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার, ইউনিভার্সাল পিকচার্স আর জিএফসির তৈরি করা এই সিনেমাটি কিন্তু বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বিনোদনের জন্যই নির্মিত। ফলে নির্মাতারা কোন অবস্থাতেই এখানে উপস্থাপিত বক্তব্য বা বার্তাগুলো কতটা সত্য বা সঠিক তার প্রমাণ দেওয়ার ব্যাপারে কোন আইনি বাধ্য-বাধকতায় নেই। এটি কোন আনুষ্ঠানিক তদন্ত প্রতিবেদনও নয়। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক ওই রিজার্ভ হ্যাকিংয়ের জন্য ‘কতটা দায়ী’- সেই বিচার করার জন্য এই প্রামাণ্যচিত্রের ওপর নির্ভর করা একেবারেই ঠিক হবে না। বরং এরই মধ্যে এফবিআইসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান রিজার্ভ হ্যাকিংয়ের ওই ঘটনা নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ যে তদন্ত প্রতিবেদনগুলো প্রকাশ করেছে সেগুলোর দিকেই আমাদের নজর থাকা উচিৎ। বলে রাখা ভালো যে, প্রকাশিত ওই তদন্ত প্রতিবেদনগুলোতে স্পষ্টভাবেই হ্যাকিংয়ের জন্য দায়ী করা হয়েছে সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক চক্রকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কেউ এই অপকর্মে সচেতনভাবে সহায়তা করেছেন এমন কথা কোথাও বলা হয়নি। সর্বশেষ নিউইয়র্কের আদালতে এ সংক্রান্ত যে মামলাটি চলছে তার রায়েও এমনটিই বলা হয়েছে। নিউইয়র্ক ফেডারেল আদালত এ বছর জানুয়ারিতে যখন ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংককে দায়ী করে বাংলাদেশের পক্ষে স্পষ্ট রায় দিয়েছে এবং বলেছে যে দ্রুত বাংলাদেশকে তার টাকা ফেরৎ দেওয়ার আলোচনা শুরু করতে তখন এমন একটি দেশবিরোধী প্রচারণা সত্যিই দুঃখজনক। এই প্রেক্ষাপটে প্রামাণ্যচিত্রের দেখানো দৃশ্যাবলির ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে দায়ী করার চেষ্টাটি একেবারেই অযৌক্তিক। বোঝাই যায় বর্তমান সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে খাটো করার জন্যই এটা করা হচ্ছে। এখন থেকে প্রায় আট বছর আগে যখন এই আক্রমণটি ঘটে তখন বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বেই সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কিত জ্ঞান ও সতর্কতাই বা কতোটুকু ছিল? যদি থাকতো তাহলে যেখানে বাংলাদেশের রিজার্ভ রাখা ছিল সেই ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকও কেন এর প্রতিরোধে ব্যর্থ হলো?

এছাড়াও প্রামাণ্যচিত্রে আমাদের রিজার্ভ হ্যাকিংয়ের আগে-পরের বিশ্ব বাস্তবতার যে চিত্র দেখানো হয়েছে সেখানেও কিন্তু নতুন কিছু নেই। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও বিস্তারিত প্রতিবেদনে এসব কথা আগেই উঠে এসেছে। বিশ্বব্যাপী সংঘবদ্ধ (এবং অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সমর্থনপ্রাপ্ত) হ্যাকার গ্রুপগুলোর যে দৌরাত্ম সাম্প্রতিক দশকগুলোতে আমরা দেখেছি তার ধারাবাহিকতায়ই বাংলাদেশের ওপর ওই সাইবার আক্রমণ হয়েছে। সনি পিকচার্সের ওপর সাইবার আক্রমণসহ বিভিন্ন আক্রমণে ল্যাজারাস গ্রুপ নামের ওই সাইবার সন্ত্রাসীদের সম্পৃক্ততার কথা আগেই গণমাধ্যমে এসেছে। প্রামাণ্যচিত্রে সেই বিষয়গুলোই আসলে আবার দেখানো হয়েছে। সংবাদ প্রতিবেদনকারীদের তুলনায় সিনেমা নির্মাতাদের বাজেট বেশি হওয়ায় হয়তো আরও সহজবোধ্য গ্রাফিক্সের মাধ্যমে সিনেমায় বিষয়গুলো তুলে ধরা গেছে। তবে জনপ্রিয়তামুখী নির্মাণশৈলীর কারণে ‘না বুঝেও বুঝে ফেলা’র ঝুঁকিও কিন্তু থাকে।

এ প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার যে, সাইবার ক্রাইমের কারণে প্রতি বছর সারা বিশ্বের জিডিপির ১ শতাংশের সমপরিমাণ ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় বিশ্ব অর্থনীতিকে। এটা ৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান। আমাদের রিজার্ভ থেকে হ্যাক হওয়া অর্থ এর একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। তার চেয়েও বড় কথা আমাদের রিজার্ভের টাকা কিন্তু হারিয়ে যায়নি। হ্যাকাররা ব্যর্থ হয়েছে। নিউইয়র্কের আদালতে মামলা চলছে। এখন পর্যন্ত সবকিছু আমাদের পক্ষেই আছে। টাকা ফেরত পাওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নয়, বরং ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংকের কিছু অসাধু কর্মকর্তাই যে হ্যাকারদের সঙ্গে কাজ করেছে এবং ফেড থেকে অর্থ সরিয়েছে সেই কথাই বলা হয়েছে নিউইয়র্ক আদালতের রায়ে। তাছাড়া স্বয়ং ফিলিপাইনের সংসদ অধিবেশনেও একই কথা বলা হয়েছে। 

সর্বত্রই এটা প্রমাণ হচ্ছে যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ স্বেচ্ছায় হ্যাকারদের সঙ্গে আঁতাত করে এই অপকর্ম ঘটাননি। সে ধরনের ‘সক্ষমতা’ও তাদের নেই। তবু এই প্রামাণ্যচিত্র মুক্তি পাওয়ার পর যখন দেখছি কিছু কিছু দেশীয় গণমাধ্যম আবার নতুন করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপরই দায় চাপাতে চাইছে- তখন হতাশ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। তাদের অপযুক্তি খণ্ডন করার মতো বক্তব্যও গণামধ্যমে কাউকে দিতে দেখি না। হয়তো মমলা চলমান এবং/অথবা তদন্তাধীন বিষয় বলেই বাংলাদেশ ব্যাংক-সহ অন্য দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষগুলোর পক্ষে সমুচিত জবাব দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

প্রামাণ্যচিত্রে কি দেখানো হলো তার ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নতুন করে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’-এর মুখোমুখি করা একেবারেই অনুচিত। তবু যদি ‘বিলিয়ন ডলার হাইস্ট’-এ কি দেখানো হলো সেদিকে নজর দেই তাতেও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের ওপর অপরাধের দায় চাপানোর মতো কিছু দেখি না। ৩৬ জন কর্মকর্তাদের কাছে হ্যাকাররা স্প্যাম পাঠিয়েছিল। তার মধ্যে তিন জন অজ্ঞানতাবশত সেই লিঙ্কে ক্লিক করায় হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেমে প্রবেশ করতে পেরেছিল। সচেতনভাবে অপরাধে সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে ওই লিঙ্কে তাদের ক্লিক করার কথা নয়। তেমনটি করলে যে তারা সহজেই ধরা পড়বেন এটা তো জানা কথা। এছাড়াও হ্যকাররা কিন্তু ওই লিঙ্ক ক্লিক করার পরও আরও দীর্ঘ সময় ব্যয় করে তারপরে সুইফট সিস্টেমে প্রবেশ করেছে। 

নিরাপত্তা জাল ভেদ করতে তাদের যে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিতে হয়েছে তা কিন্তু প্রামাণ্যচিত্রেও দেখানো হয়েছে। ওই সময়ে আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথা সারা দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা ওই রকম একটি সাইবার আক্রমণ ঠেকানোর মতো শক্তিশালী ছিল না। আর এই অপ্রতুলতার দায় কিন্তু শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের নয়। নিউইয়র্কের ফেড আর সুইফটেরও। প্রামাণ্যচিত্রেও এটা স্বীকার করা হয়েছে। আর বাস্তবে নিউইয়র্কের আদালত তো এই অপ্রতুলতার দায় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে মুক্তিই দিয়েছে। ফেডও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে এমওইউ করে বাংলাদেশকে এই মামলায় সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে সাইবার আক্রমণের পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের দাবি/পরামর্শের প্রেক্ষিতেই নিউইয়র্ক ফেডে ২৪ ঘণ্টার হটলাইন চালু করা হয়। এর আগে এই ব্যবস্থাই ছিল না। বলা যায় এই দূর্ঘটনা সারা বিশ্বের সাইবার নিরাপত্তাকে জোরদার করতে সাহায্য করেছে।

এছাড়াও প্রামাণ্যচিত্রে দেখানো হয়েছে সুইফটের পক্ষ থেকে লেনদেন ব্যবস্থা বন্ধ করার পরামর্শ দেওয়ার পরও বাংলাদেশ ব্যাংক ওই সিস্টেম চালু রেখেছে। ঘটনাটি আসলেই এমন ছিল কি-না তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে। এ কথাটি যে মনগড়া নয় অথবা স্বার্থান্বেষী কারও মন্তব্য নয় তাই বা কী করে বলা যায়? কারণ সুইফট কর্তৃপক্ষ যদি ঝুঁকিপূর্ণ মনে করত তাহলে তারাই ব্যবস্থাটি বন্ধ করতে পারত। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শ/সিদ্ধান্ত কি তাদের আদৌ দরকার ছিল? আর টাকা হ্যাক হয়ে চলে যাবার পর লেনদেন ব্যবস্থা বন্ধ করলেই বা কি লাভ হতো? উল্টো কারা টাকা হ্যাক করে কোথায় নিয়ে গেছে সেটা খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতো কি-না?- এ প্রশ্নগুলোও করা উচিৎ। 

এটা তো মানতেই হবে যে, গেল সাত বছরে যতটা আশা করা হয়েছিল হ্যাক হওয়া অর্থ উদ্ধারে ততটা সফলতা আসেনি। একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে অর্থ উদ্ধার প্রক্রিয়া কিন্তু বন্ধও হয়ে যায়নি। ওই সময়ের বাস্তবতায় আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কারিগরি জ্ঞানের পরিধি ওই পর্যায়ে হয়তো ছিল না। তার জেরেই দুষ্টচক্র সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে ওই সময়ে ডিজিটাল অর্থায়ন বিষয়ে সাহসী পদক্ষেপ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তরফ থেকে নেওয়া হয়েছিল বলে এই একটি দুর্ঘটনা বাদে অন্য সকল ক্ষেত্রেই আমরা দারুণ সফলতা পেয়েছি। ডিজিটাল লেনদেনের সুবাদে আমাদের প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে। কোভিডকালে পঞ্চাশ লাখ গার্মেন্টসকর্মীদের মোবাইল আর্থিক সেবার মাধ্যমে বেতন দেওয়া, সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু রাখা, ইলেক্ট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার ও আরটিজিএস ব্যবস্থায় সকল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু রাখার মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাফল্যগুলোকে ইচ্ছে করলেই তালি মেরে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব?

লেখক: সাংবাদিক

ashrafulislam09@gmail.com