নালায় প্রাণহানি
এ কেমন মৃত্যু ইয়াছিন!

শিশু ইয়াছিন
ফারুক ওয়াসিফ
প্রকাশ: ২৯ আগu ২০২৩ | ২১:২২ | আপডেট: ২৯ আগu ২০২৩ | ২১:২২
ছবি দুটির দিকে তাকানো যাচ্ছে না। তৃতীয় ছবিটা দেখিনি; দেখা কি সম্ভব? পড়ে যাওয়ার ১৬ ঘণ্টা পরে আবর্জনায় ভরা নালা থেকে তুলে আনা হলো দেড় বছরের শিশু ইয়াছিনের লাশ। এমন মাসুম শিশুর লাশ কি দেখা সম্ভব? সম্ভব না। তাই মায়ের কান্নার মাতমের ছবি দেখতে পারছি, নিস্তেজ পিতার বোবা চাহনির ছবিও দেখা হলো। এমনকি জীবিত ইয়াছিনের সুন্দর ফুটফুটে মুখটার দিকে তাকিয়েও বলতে পারছি, ‘আহা! আহা রে জীবন!’
কিন্তু হে জীবন-মৃত্যুর ম্যানেজার, হে নাগরিকের বেঁচে থাকার অধিকারের পাহারাদার, হে মহান কর্তৃপক্ষ, হে নগরপিতাগণ এবং আপনাদের ভাইবেরাদর কমিশনার ও কাউন্সিলরগণ, হে সভাসদ– আপনারা কি পারবেন এই দুই মাতা-পিতার চোখে চোখ রেখে তাকাতে? তাদের শোক যন্ত্রণার ভয়াবহতা কোনো সাউন্ডট্র্যাকে বাজিয়ে শুনতে? কয়েকটি ঘণ্টা তাদের পাশে বসে থাকতে?
বর্ষার স্বাভাবিক বৃষ্টিতে একটা মহানগর তলিয়ে গেল। চট্টগ্রামের অবহেলায় তৈরি হওয়া বন্যায় প্রাণও গেল বিশের অধিক আদম সন্তানের। যে ভুল অবকাঠামোর শিকার এরা হলেন, এসব মৃত্যুকে কেন কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড বলা হবে না? যখন সিস্টেমের ভুল কিংবা কর্তৃপক্ষের অবহেলায় কারও মৃত্যু হয়, তাকে বলা হয় কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড– স্ট্রাকচারাল কিলিং। ইয়াছিনের মতো দুধের শিশু কিংবা নিপা পালিতের মতো স্বপ্নে টগবগ করা ছাত্রীর নালায় পড়ে মৃত্যুর আর কী নাম হতে পারে?
ইয়াছিনের মা নাসরিনকে সব দেখতে হয়েছে। তাঁর চোখে নিশ্চয়ই ভাসছে এক দিন আগের সুস্থ-স্বাভাবিক প্রাণশক্তিতে ভরপুর ইয়াছিনের মুখচ্ছবি, তার দুষ্টুমি, তার ‘মা’ ডাক, তার আহ্লাদ। কিন্তু নালায় পড়ার ১৬ ঘণ্টা পরে যাকে উদ্ধার করে আনা হলো, সে কে? এই মৃত, নালার আবর্জনা মাখা, অস্বাভাবিক মৃতদেহটি কী করে তাঁর আদরের জানবাচ্চা হবে? দুটি ছবি তো মিলবার নয়!
বাবা সাদ্দামকে নিজ হাতে কবরে শোয়াতে হয়েছে প্রাণাধিক সন্তানকে। গাড়িচালকের কাজে থাকতেন নবীনগরে। খবর পেয়েই ছুটে আসেন। নিজেই নেমে পড়েন বাড়ির সামনের নালার ভেতর। কিন্তু পেলেন না…। ১৭ ঘণ্টা পরে ফায়ার সার্ভিস খুঁজে আনে ইয়াছিনকে। এ দেশে বাবা-মা হওয়ার এই-ই কি প্রায়শ্চিত্ত? যাদের ভালোবাসা সবচেয়ে বেশি, শোকে বোবা হতে হয় তাদেরই সবচেয়ে বেশি। বোবা যন্ত্রণার কৃষ্ণগহ্বর তাদের একাই পেরোতে হয়। যেমনটা করতে হচ্ছে নাসরিন আর সাদ্দাম নামের এই তরুণ মা-বাবাকে। বাজি ধরে বলতে পারি, কর্তৃপক্ষের পরিবারের বসবাস এই অকহতব্য বাস্তবতার বাইরে। এই যন্ত্রণাময় বাস্তবতার সঙ্গে তাদের হয়নাকো দেখা।
নালায় শুধু চট্টগ্রামের শিশু ইয়াছিন একাই পড়েনি, আমরা দেশসুদ্ধ কি নালা-ডোবা-ধসের মধ্যে পড়ে যাচ্ছি না! কয়েক দিন আগে নিপা পালিত নামের এক কলেজছাত্রী– এই চট্টগ্রামেই– এভাবেই নালায় পড়ে দম আটকে মারা গেছে। আহারে জীবন; কী হতভাগ্য জীবন! কী রকম এক খরচযোগ্য জীবন হয়ে যাচ্ছে আমাদের। রেলগেটে গাড়ি আটকে মারা গেলেন তিন পুলিশ, খাগড়াছড়িতে এক শিক্ষক পিটিয়ে মেরে ফেললেন তাঁর ছাত্রকে। ওহো না, পরিসংখ্যান দিয়ে কী লাভ! যারা একটি প্রাণের মূল্য বোঝেন না, শত প্রাণের হাহাকার কি তাদের কানের পর্দায় বাজবে?
একটি অপমৃত্যুও কি মেনে নেওয়া যায়? মেনে নিচ্ছেন না ইয়াছিনের বাবা সাদ্দাম: ‘নালার ওপর স্লাব থাকলে আমার ছেলে সেখানে পড়ে যেত না। এর জন্য যারা দায়ী, তাদের ক্ষমা করব না। নগরে এমন অনেক উন্মুক্ত নালা-নর্দমা আছে। শিগগিরই এগুলো ঢাকা না হলে আরও অনেক মা-বাবার বুক খালি হবে।’
গত দুই বছরে শুধু নালার ফাঁদে প্রাণ হারিয়েছেন সাতজন। তারা কার কাছে বিচার চাইবেন? অবহেলাজনিত মৃত্যুর দায় চিহ্নিত করার উপযুক্ত আইন কি আমাদের আছে?
গত ৭ আগস্ট নিপা পালিত উন্মুক্ত নালায় পড়ে মারা গেল, এলাকার কমিশনার এখনও সেটা খোলাই রেখে দিয়েছেন। আরেকবার কেউ পড়লে কী হবে, সেই হুঁশ বা মানবিকতা তাঁর জাগল না? এ কাদের অধীনে বাস করছি আমরা?
অথচ কী নির্বিকার এলাকার কমিশনার। চট্টগ্রামে উত্তর আগ্রাবাদের রঙ্গিপাড়া এলাকার ২৪ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার নাজমুল হক বলেছেন, ‘বৃষ্টির কারণে নালায় পানি ছিল, নিয়মিত বিরতিতে আবর্জনা পরিষ্কার করা হয়।’ এতই পরিষ্কার, তবে উপচানো পানিতে সড়ক আর নালা একাকার হয় কী করে? কেন নালার জায়গায় জায়গায় স্লাব থাকে না!
মেয়র আর নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কেউ নিজের দোষ খুঁজে পাচ্ছেন না। তাহলে কে দোষী? মৃত্যুপুরীতে জন্মানোই যখন অপরাধ, তখন অপমৃত্যুকে মনে হবে স্বাভাবিক। যে মরল সে-ই দোষী। কবিতায় তো বলাই হয়েছে, ‘জন্মই যেখানে আজন্ম পাপ’, সেখানে কেন জন্মেছিলি ইয়াছিন!
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক এবং সমকালের পরিকল্পনা সম্পাদক
farukwasif0@gmail.com
- বিষয় :
- নালায় প্রাণহানি
- ইয়াছিন!