পশুকে নিয়েও রাজনীতি

বহ্নি ফারহানা
প্রকাশ: ০৬ জুন ২০২০ | ০৬:১৫ | আপডেট: ০৬ জুন ২০২০ | ০৬:৩৯
ভারতের গুজরাটে ২০০২ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় সেনাবাহিনীকে বসিয়ে রেখে দু'হাজারেরও বেশি লোককে মারা হয়েছিল। এই কাণ্ড যখন ঘটে, তখন আমি অনেক ছোট ছিলাম। পরে নরেন্দ্র মোদি ভারতের ক্ষমতায় আসার পর ঘটনাটি আবার আলোচনায় এলো। ২০১৪ সাল থেকে আমি মোদিকে নিয়ে বেশ মনোযোগের সঙ্গেই অনেক কিছু দেখছি। বিশেষ করে তৃণমূল কংগ্রেস থেকে যখন তাকে 'গুজরাটের কসাই' বলা হয়েছিল, তখন থেকেই বিষয়টা খেয়াল করতে শুরু করি। দাঙ্গার সময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন আজকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
আমার এত কথা বলার উদ্দেশ্য হাতি হত্যা নিয়ে বিজেপির অতি কান্না। ঘটনাটি ঘটেছে ভারতের কেরালার পালাক্কাড় জেলায়, গত ২৭ মে বুধবার। সবার মতোই ঘটনাটি আমাকে অত্যন্ত ব্যথিত করেছে। আনারসের মধ্যে বাজি ভরে দিয়ে একটা গর্ভবতী হাতিকে হত্যার ঘটনা মানবিকতার সংজ্ঞাটাকেই নিরর্থক করে দেয়। অবশ্য এখন দেখছি, হাতিটি আনারস নয়, আতশবাজি ভর্তি নারকেল ভেঙে বিস্ফোরক পদার্থসহ একটি অংশ খেয়ে ফেলেছিল এবং এতে হাতির পুরো মুখ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। যার ফলে কয়েকদিন ধরেই জল বা কোনো খাবার খেতে না পেরে সে দুর্বল হয়ে পড়ে।
রামভক্ত বিজেপির কাছে হাতি তো গণেশের প্রতিমূর্তি। বিজেপি অনুসারীদের দাবি, কেরালায় শিক্ষিত বামপন্থীদের নাকি এটাই সংস্কৃতি। অভিযুক্ত হিসেবে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হওয়া একমাত্র ব্যক্তির নাম উইলসন, তিনি খ্রিষ্টান। ফলে রামভক্তদের জন্য এটা মোক্ষম সুযোগ। তবে এটা সত্য, যারাই একটা নিরীহ হাতিকে হত্যার জন্য দায়ী হোক না কেন, তারা ক্ষমার অযোগ্য। হাতিটি গর্ভবতী ছিল। খিদের জ্বালায় একটু খাবারের খোঁজ করছিলো লোকালয়ে এসে। আনারসের মধ্যে আতশবাজি পুরে তাকে দেওয়া হলো খেতে। মুখের ভেতরে বাজি ফোটার পরেও ১৪ দিন ওই অবস্থায় বেঁচেছিল গর্ভবতী হাতিটি। ঝলসে যাওয়া মুখ-গলা নিয়ে নদীতে দাঁড়িয়ে ছিল সে। মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো হাতিটির কোনো চিকিৎসা করা সম্ভব হয়নি। আতশবাজি খাইয়ে খুন করা গর্ভবতী হাতির ময়নাতদন্তের রিপোর্টে জানা যায়, মুখের ভেতরে বাজি ফোটার কারণে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল তার মুখ-গলা। পানি ঢুকে ফুসফুস কাজ করা বন্ধ করে দেওয়াতেই তার মৃত্যু হয়।
মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি ভারতীয় উপমহাদেশে নতুন কিছু নয়। কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে নির্দেশ পেয়ে বিজেপির সমর্থকরা সঙ্গে সঙ্গে নেমে পড়লেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। তাদের কাছে ঘটনার নৃশংসতা বড়ো নয়। তাদের মূল প্রতিবাদ হচ্ছে, কেরালার যে মডেলকে এতদিন প্রশংসা করা হয়েছে, কেরালা মানেই শিক্ষিত, কেরালা মানেই উদারপন্থী, তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। দেখো কেরালার কাণ্ড
যারা বামপন্থী এবং শিক্ষিত হয়েও এভাবে পশুহত্যা করে, তাদের থেকে যারা গরুকে মায়ের মতো পূজা করে তারা অনেক ভালো। অথচ হাতিটিকে নিয়ে কান্না করতে নামা এই বিজেপি সমর্থকরাই গরুর মাংস খাওয়ার অপরাধে মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করে। সেই হত্যার বিচার হয় না। সেই বিজেপি একটি পশু হত্যার বিচার চাওয়ার মধ্যে রাজনীতি করছে। যখন বনের পর বন নিধন করে পশুর আবাসস্থল নষ্ট হয়, তখন কিন্তু সরকারগুলোর ঘুম ভাঙে না।
বাংলাদেশেও কিন্তু আমরা হাতির চলাচলের পথে রেললাইন করার পরিকল্পনা করছি। চুনতি অভয়ারণ্যের ভেতর দিয়ে প্রস্তাবিত রেললাইনের ওপরেই রয়েছে হাতি চলাচলের সক্রিয় ও মৌসুমি করিডোর। এই নিয়ে ‘সমকাল’সহ কয়েকটি পত্রিকায় এরই মধ্যে রিপোর্ট হয়েছে। কিন্তু সরকারি পরিকল্পনার কোনো নড়নচড়ন হয়নি এখনো, অন্তত এমন কিছু আমাদের জানা নেই।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের প্রায় ২৭ কিলোমিটার বন্যহাতির জন্য মরণফাঁদে পরিণত হবে। ওই রেললাইনের অন্তত ২১টি স্থানে পড়বে হাতির বসতি এবং চলাচলের পথ। মধুপুরের বনাঞ্চলের কিছু এলাকা ঘুরে এবং সেখানকার আদিবাসীদের সঙ্গে কিছুদিন কাটিয়ে আমি বুঝতে পেরেছি, বনের পশুপাখি তো দূরের কথা, বনজীবী মানুষদের জন্য সরকারগুলোর কোনো মায়া নেই, সে যখন যে ক্ষমতায় থাকুক না কেন?
ভারতীয় একটি পত্রিকায় দেখলাম, লকডাউনের সময় মোদি সরকার সবার চোখের আড়ালে প্রায় ১৯১টি প্রকল্পের ছাড়পত্র দিয়েছে, যেগুলো এতকাল পরিবেশ আন্দোলনের কারণে ধামাচাপা পড়েছিল। সেই সব প্রকল্প চালু হলে গোটা ভারতের সবুজ ধ্বংস হয়ে যাবে। পশুপাখির থাকার জায়গা থাকবে না। পশ্চিমঘাট পর্বতমালার কয়েক হাজার হেক্টর বনাঞ্চল কেটে ফেলা হবে। অরুণাচলের কয়েক লাখ হেক্টর জঙ্গল সাফ করে ফেলা হবে। আসামের অভয়ারণ্যের মধ্যে দিয়ে তৈরি হবে রাস্তা। ওডিশার জঙ্গলের মধ্যে কোল পাওয়ার প্লান্ট হবে। তেলেঙ্গানার জঙ্গলে হবে খনন কাজ। দক্ষিণের জঙ্গলের মধ্যে কারখানা তৈরি হবে। কয়েক লাখ বন্যপ্রাণীর বাসস্থান ধ্বংস হয়ে যাবে। এরা আশ্রয়ের জন্য এবং খাবারের জন্য লোকালয়ে চলে আসবে। তখন অরণ্যনির্ভর গ্রামবাসী তাদের পিটিয়ে অথবা আতশবাজি খাইয়ে মেরে ফেলবে। সেটা নিশ্চয়ই আমাদের কাঙ্ক্ষিত নয়!
আমরা হয়তো পশুটির জন্য কাঁদব। কিন্তু নিহত পশুটিকে অনেকেই রাজনীতির হাতিয়ার করবে, এখন যেমন করা হচ্ছে, কেরালার হাতি হত্যা নিয়ে। মানুষ মানুষকে নিয়ে রাজনীতি করে, মানুষ পশুকে নিয়েও রাজনীতি করে। অন্তত কেরালার হাতি হত্যার পর যা হচ্ছে, তা থেকে রাজনীতিটা স্পষ্ট হচ্ছে। বলা হচ্ছে, শুকড়ের জন্য এই ফাঁদ পাতা ছিল। যে কোনো পশুকেই এইভাবে মারাটা অমানবিক।
ছোটবেলায় সার্কাসের হাতি দেখতে নিয়ে গিয়েছিল আব্বু। হাতিও বল নিয়ে খেলতে পারে দেখে খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম। তবে সার্কাসে হাতির খেলা থেকে সামনা সামনি হাতি দেখার আগ্রহই আমার বেশি ছিল। নিশ্চয়ই হাতি দেখতে যাব একদিন কোনো এক অরণ্যের কাছে। সেই ছোটবেলায় যখন হাতি দেখতে যাওয়ার আগ্রহটা জন্ম নিয়েছিল, তখন জানতাম না, এই সার্কাসের জন্য হাতিকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় তার ওপর কী (অ)মানবিক নির্যাতন করা হয়! ইচ্ছে করেই ‘অ’ অক্ষরটিকে ব্র্যাকেটবন্দী করেছি আমি।
যাই হোক, সার্কাসের হাতিকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় হাতিকে বেঁধে মারা হয়। হাতি যতদিন পর্যন্ত কথা শুনে না, ততদিন পর্যন্ত বেঁধে রাখা হয়। এভাবে মানুষকে বিনোদন দেওয়ার জন্য হাতিকে প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু মানুষকে আমরা বলি মানবিক আর যখন মানুষ অমানবিক কিছু করে তখন বলি পাশবিক। ঠিক করেছি, আর কোনোদিনই মানুষের নিষ্ঠুরতা বোঝাতে পাশবিক শব্দটি ব্যবহার করব না। পশু তো কখনোই নিজের প্রয়োজনীয় খাবারের অতিরিক্ত হত্যা করে না। এটা মানুষের স্বভাব। পাশবিক বোঝাতে আমরা মানবিক শব্দটি ব্যবহার করতে পারি।
কেরালার হাতিটি আহত হয়ে নদীতে নামার আগে। কয়েকদিন টানা গ্রামটিতে ঘুরে বেড়িয়েছে। কারো ক্ষতি সে করেনি। একটা সময় মনে হতো মানুষ কেন সিংহাসনে আরোহন করে, কেন সফল মানুষকে বাঘের বাচ্চা বলা হয়? মানুষ তো সব প্রাণীর সেরা। বড় হতে হতে বুঝতে পেরেছি মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিটা কত ঠুনকো।
হুমায়ূন আহমেদ একবার হাতি দেখতে স্ত্রী, পুত্র, কন্যা নিয়ে শ্রীমঙ্গলে যাওয়ার একটা বর্ণনা দিয়েছিলেন, তার ‘আমার সকল কাঁটা ধন্য করে’ বইয়ে— ‘‘হাতির বাচ্চা দেখে প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম। ছোট খাটো একটা বাচ্চা হাতি। তার সামনের দুটা পা আর পেছনের দুটা পা শিকল দিয়ে বেধে টানা দিয়ে রাখা হয়েছে। তার নড়াচড়ার শক্তি নেই। তার শুঁড় নানা জায়গায় কাটা। রক্ত পড়ছে। চোখ ভেজা। সে নিঃশব্দে কাঁদছে। জানা গেলো বাচ্চাটিকে এভাবে ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে যেন সে বন থেকে কাঠ টেনে আনতে পারে এই ট্রেনিং। আমি বললাম, ‘একে আপনারা এভাবে মারছেন?’ ‘না মারলে শিখবে কিভাবে?’ ‘এভাবে টানা দিয়ে কতক্ষণ রাখা হয়?’ ‘মাঝে মাঝে দুদিন তিনদিনও রাখা হয়। খাওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। হাতির ট্রেনিং বড়ই কঠিন।’ হাতির বাচ্চা হুঙ্কারের মতো করল। মাহুত সাথে সাথে তার শুঁড়ে প্রচণ্ড মারলো। আমরা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। ছবি হলো না, ভিডিও ক্যামেরায় ভিডিও করা হলো না। মানুষ হয়ে জন্মেছি এই লজ্জা ও এই অপমান সহ্য করে মাথা নিচু করে ফিরে এলাম। মনে মনে বললাম, জগতের সমস্ত পশু, তোমরা আমাদের মানুষ হয়ে জন্মানোর এই অপরাধ ক্ষমা করে দাও।’’
লেখক : সাংবাদিকতার শিক্ষার্থী