ঢাকা শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

ত্রাণ বা প্রণোদনায় ব্যবহার করুন জাতীয় পরিচয়পত্র

ত্রাণ বা প্রণোদনায় ব্যবহার করুন জাতীয় পরিচয়পত্র

সনজিৎ নারায়ণ চৌধুরী

প্রকাশ: ২৯ জুন ২০২০ | ০৩:০৪ | আপডেট: ২৯ জুন ২০২০ | ০৬:৫১

করোনাকালে মানবিক সহায়তার অংশ হিসেবে সরকারের পক্ষ হতে কর্মহীন মানুষের কথা চিন্তা করে চাল, আলু, ডাল, তেল, পিঁয়াজ ইত্যাদি শুকনো খাবার এবং শিশুদের জন্য দুধ বিভিন্ন ধাপে পৌঁছানোর মহৎ কর্মসূচি চলমান রয়েছে। এছাড়া করোনাপূর্ব সময় থেকেই চলমান রয়েছে ১০ টাকা কেজি দরে কার্ড মাধ্যমে চাল বিক্রি, দুঃস্থ ভাতা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতাসহ নানা ধরনের সহায়তা।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার হিসেবে পরিবার প্রতি ২৫০০ টাকা করে নিম্ন আয়ের বিভিন্ন পেশার ৫০ লক্ষ পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। কর্মসূচি ঘোষিত হওয়ার পর এই টাকা পাওয়ার কৌশল নিয়ে কোথাও কোথাও এক শ্রেণির ধান্দাবাজ নাটকীয় ঘটনার জন্ম দিয়েছে। এতে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। সরকারের খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির সহায়তায় দরিদ্র জনগোষ্ঠী বর্তমানে যেসব সহায়তা পাচ্ছে, তারা নগদ সহায়তা পাবে না। সরকার অসহায় সকল শ্রেণি-পেশার সর্বাধিক সংখ্যক জনগণকে সাহায্য করার লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু কিছু জায়গায় তালিকা প্রণয়নে নিয়োজিত ব্যক্তিরা এই নির্দেশনা পালন করেননি।

কোথাও কোথাও তথ্য গোপন করে ওএমএস চালের উপকারভোগীর তালিকায় স্বচ্ছল গৃহবধূকে গৃহকর্মী, কাপড় ব্যবসায়ীকে রংমিস্ত্রি কিংবা বস্তির ভাড়াটিয়া ঘরের মালিককে রিকশাচালক দেখানো হয়েছে। আবার কোনো এলাকার জনপ্রতিনিধি ধনী-মধ্যবিত্ত-গরিব-চিকিৎসক-গৃহিনী ইত্যাদি নানা পেশার যাদের নামই তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করেছেন তাদের সকলের পেশা 'দিনমজুর' লিখেছেন। গরিব কোনো লোককে দিনমজুর বললে হয়তো পার পেয়ে যেতে পারেন কিন্তু অন্য পেশার লোকদের কোন্ অধিকারে দিনমজুর বলছেন? চিকিৎসক বা গৃহিনীর পেশা কী করে দিনমজুর হয়?

দালাল শ্রেণির লোকেরা স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে সরকারের সব ধরনের সহায়তার তালিকায় তাদের নিজেদের লোকদের রাখতে চায়। অন্য আরো দশজন পেলো কি না তা তাদের চিন্তায়ও রাখতে চায় না। আবার ২৫০০ টাকা যেহেতু মোবাইল নাম্বারের মাধ্যমে 'নগদ নারায়ণ' সরাসরি পাওয়া যাবে তাই কোনো কোনো প্রতারক অনেক ব্যক্তির নামের অনুকূলে একটি ফোন নাম্বার দিয়েছিলো, যাতে করে টাকা গ্রহণের পর ওই টাকায় 'ভাগ' বসানো যায় অথবা টাকা হাতিয়ে নেওয়া যায়। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী পরিবার প্রতি একজনই ওই টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু কোথাও কোথাও একই পরিবারের ২/৩ জনের নামও তালিকায় থাকার অভিযোগ দেখা গেছে।

ব্যক্তির ভূসম্পত্তির পরিমাণের তথ্য ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকে শুরু করে উপজেলা, জেলা, মন্ত্রণালয় পর্যন্ত সংরক্ষিত আছে। জমির খতিয়ানে ব্যক্তির নামের সাথে তার জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর একটি ডাটাবেইসে যোগ করে ওই ব্যক্তির মোট জমির পরিমাণ নির্ণয় করা সম্ভব। একজন ব্যক্তির কী পরিমাণ জমি তার নিজ নামে রেকর্ড থাকলে তাকে সরকারি সহায়তা দেওয়া যাবে বা যাবে না তা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নির্ধারণ করাও যেতে পারে। কেউ যদি জমি অনাবাদি রাখে তার সহায়তা প্রাপ্তির বিষয়টিও আলোচনান্তে সিদ্ধান্ত হবে।

সরকার প্রতি বছরই কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় করে থাকে। মাঝে মাঝে এক শ্রেণির দালাল কৃষকদের ঠকিয়ে মুনাফা লুটে নেয়। এতে অনেক কৃষক কথিত দালাল নেতার জিম্মি থেকে রেহাই পেতে সরকারের কাছে ধান বিক্রয়ে উৎসাহ হারান। বারবার যদি কোনো কৃষক ক্ষতির সম্মুখীন হন তবে ধান চাষের বিকল্প ভাবেন অথবা ধানচাষ ছেড়ে দেন। সামান্য ব্যতিক্রম বাদে এ বছর নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের আভাস থাকলেও সব অতিক্রম করে কৃষক ঘরে ধান উঠিয়েছেন অনেকটা নিরাপদে। তাই এবছর হয়েছে 'সোনার বৈশাখ'।

কোন কৃষকের কাছে কী পরিমাণ ধান রয়েছে তার হিসাব না নিয়ে উপজেলা থেকে নির্দেশনা দিয়ে কৃষি কার্ড সংগ্রহ করে সরকারের পক্ষে প্রকৃত কৃষক থেকে ধান ক্রয় কখনোই সম্ভব নয়। সরকারের ধান ক্রয় ঘোষণার সাথে সাথে প্রায় বছরই কৃষক নামধারী কিছু ব্যক্তির কৃষি কার্ড বানানোর হিড়িক পড়ে। শুরুতেই যদি যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে প্রকৃত কৃষকদের কার্ড তৈরি হয় তাহলে ভালো হয়। নইলে প্রকৃত কৃষকদের সাথে অকৃষকরাও ধান বিক্রির জন্য যথাস্থানে আবেদন করে বা কার্ড জমা দেয়। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আবেদন বেশি হলে প্রয়োজনীয় কৃষক বাছাই করতে 'লটারি' করা হয়। এতে অনেক সময় লটারিতে টিকে যায় অকৃষকরাও। আর, অকৃষকদের ধান না থাকায় এরা হন্যে হয়ে ছুটে ধান সংগ্রহে। কখনো কখনো প্রকৃত কৃষকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে ধান সংগ্রহ ও সরকারের ধান ক্রয় গুদামেও পৌঁছাতে সফল হয়। শেষতক ব্যাপারটা দাঁড়ালো, কৃষক না হয়েও কৃষক হওয়া যায় এবং লাভও করা যায়। আর, ঠকলো মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সোনার ফসল ফলানো মালিক অর্থাৎ প্রকৃত কৃষক।

ত্রাণ বা প্রণোদনা বণ্টনে আমাদের জাতীয় পরিচয় পত্র ও জন্মনিবন্ধন সনদের কোড কানেক্ট করলেই অনিয়মের সুযোগ অনেক কমে যাবে। সম্প্রতি খানা জরিপও সম্পন্ন হয়েছে। খানা জরিপের মাধ্যমে একটি পরিবারে কতজন লোক রয়েছেন তা জানা গেছে। একটি পরিবারের জন্য একটি কোড ব্যবহার করে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যদের জাতীয় পরিচয়পত্রের সাথে নানা তথ্য (যেমন-পেশা, অর্থনৈতিক অবস্থাসহ নানা তথ্য) যোগ করে একটি ডাটাবেইজ তৈরি করলে নানা দুর্যোগে সহায়তা প্রদান এবং অন্যান্য সমস্যা মোকাবেলা ও উন্নয়নমূলক কাজে পরিকল্পনা গ্রহণ অনেকটা সহজেই সম্ভব।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক

আরও পড়ুন

×