ঢাকা বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫

সাম্প্রদায়িকতার কাছে পরাজিত হবে ভারত?

সাম্প্রদায়িকতার কাছে পরাজিত হবে ভারত?

গৌতম রায়

গৌতম রায়

প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২০ | ০৮:৪১ | আপডেট: ২৪ আগস্ট ২০২০ | ০৮:৫৭

বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের ওপর তথাকথিত মন্দিরের ভিত পূজাকে সমর্থন না করলে আর হিন্দু হিসেবে জন্মসূত্রে হিন্দুরা বুঝি আর পরিগণিত হবেন না- এমন একটা আত্মঘাতী প্রবণতা ভারতীয় সমাজে ছড়িয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চলেছে।

প্রাচীন সাহিত্যের দশরথনন্দন 'রাম' ঘিরে কারও ভাবাবেগ থাকতেই পারে। তাকে কেউ রক্ত-মাংসের মানুষ ভাবতেই পারেন। তাকে ঈশ্বরের অবতার ভাবতেও তো বিশ্বাসীদের কোনো বাধা নেই। আবার কেউ রামকে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের এক কালজয়ী চরিত্র হিসেবেও নিতে পারেন। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বা দ্বীপময় ভারতে রামকাহিনির বৈচিত্র্যেও কেউ বিশ্বাসী হতে পারেন, নাও হতে পারেন। দশরথ জাতকে বর্ণিত রামকাহিনিতে বিশ্বাসী হওয়ার অধিকারও মানুষের আছে। অবিশ্বাসী হয়ে নরোত্তম রামকে ঘিরে আধ্যাত্মিক আকুল হওয়ার অধিকারও মানুষের আছে।

হেসিয়াডের লেখা গ্রিক মিথোলজি 'থিওগোনিয়া'র সঙ্গে রামকাহিনির সাদৃশ্য দেখে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতো মানুষের সন্দর্ভ লেখার অধিকার এ ভারতেই একদিন স্বীকৃত ছিল। যে সুনীতিকুমার প্রচলিত হিন্দু ধর্মের রীতিনীতির প্রতি আস্থাবান ছিলেন; যে সুনীতিকুমার তার বন্ধু নরেন্দ্র দেবের মৃত্যুর পর, বন্ধুকন্যা নবনীতা আয়োজিত পিতৃশ্রাদ্ধে পৌরহিত্য করেছিলেন; সেই সুনীতিকুমারের গ্রিক পুরাকাহিনির সঙ্গে রামকাহিনির সাদৃশ্য টানাকে পুরাতাত্ত্বিক বিচারে অনেক পণ্ডিত সমর্থন করতে পারেননি।

এই বহুত্ববাদের চর্চার ভেতর দিয়েই একুশ শতকের উন্নত প্রযুক্তিতে ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো উপনীত হয়েছে। রামকে বিশ্বাস করা আর ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের জমিতে দশরথনন্দনের জন্ম- এই অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস করা কখনও এক জিনিস হতে পারে না। অযোধ্যায় আরও বহু রামচন্দ্রের মন্দির আছে। যে মন্দিরগুলো ঘিরে ভক্তদের বিশ্বাস, সেখানেই রামের জন্ম। মন্দির কর্তৃপক্ষ সাধু, মোহান্তদেরও বিশ্বাস, তাদের দেবস্থানেই জন্মছিলেন দশরথনন্দন।

বস্তুত শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন উনিশ শতকের অন্যতম সেরা সমন্বয়ী চেতনার প্রতীক। বহুত্ববাদী ভারত শ্রীরামকৃষ্ণের চিন্তাচেতনায় মূর্ত হয়ে উঠেছিল। জাত, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ- এসব কোনো কিছুরই তিনি পরোয়া করেননি। প্রথম জীবনে দক্ষিণেশ্বরে অবস্থানকালে জটাধারী নামক এক সাধু একটি রামচন্দ্রের মূর্তি দিয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণকে। সেই রামচন্দ্রকে কার্যত সখা রূপে বরণ করে তাকে ভালোবাসার নিগড়ে বেঁধে সাধনা করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ।

দশরথনন্দন রাম আপামর দেশবাসীর কাছে যেমন বালগোপাল স্বরূপ, শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনেও দেখা যায়, জটাধারী সাধুর কাছ থেকে পাওয়া রামচন্দ্রের মূর্তি তার কাছে শিশুরূপধারী বলেই পরিগণিত হতো। বাবরি মসজিদ ভাঙার জন্য লালকৃষ্ণ আদভানি যে তথাকথিত রথযাত্রা করেছিলেন, সেখানে ছিলেন তীর-ধনুকধারী যোদ্ধাবেশী রাম। আর শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনে রাম ছিলেন পরম ভালোবাসার এক সাথি। তার জীবনীতে উল্লিখিত হয়েছে, সখী রূপ রাম বিভিন্নভাবে তাকে বিরক্ত করায় রামকে শান্ত করতে একটু খই খেতে দিয়েছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। খই থেকে ধান তিনি বেছে দেননি। ফলে শিশু রামের জিভ সেই ধানে চিরে গেছে। ফলে শ্রীরামকৃষ্ণ খুব আক্ষেপ করছেন; মা কৌশল্যা ক্ষীর, ননীও যে মুখে বহু যত্নে তুলে দিতেন, আর আমি কিনা সেই মুখে ধানসুদ্ধ খই দিয়েছি?

এই ভালোবাসার নিগড়ে আপামর ভারতবাসী রামকে দেখতে অভ্যস্ত। জাতি-ধর্মের ব্যবধানে নয়। ভাষার বৈচিত্র্যে নয়। ঘরের ছেলের ভালোবাসায় ভারতবাসী রামকে দেখে। সীতাপতি রামকে ভালোবাসে। ভাইদের প্রতি ভালোবাসায় ভরে থাকা দশরথনন্দনের তারা অনুরাগী। সেই রামকে বিসর্জন দিয়ে, যুদ্ধরত রামকে প্রধান কেন্দ্রবিন্দু করে, রামের মন্দির তৈরির ভিত পূজার জন্য বেলুড় মঠ থেকে মাটি পাঠানো শ্রীরামকৃষ্ণের সমন্বয়ী চেতনাকেই অমান্য করা। স্বামী বিবেকানন্দের শিবজ্ঞানে জীবসেবাকেই অবজ্ঞা করা। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম জীবনে রামকে ঘিরে সেই বন্ধুবৎসল মানসিকতাকেই অসম্মান করা, অমর্যাদা করা।

রামকৃষ্ণ পরিমণ্ডলে ধর্মান্তর আদৌ অনুমোদিত নয়। এ জন্য ধর্মান্তরের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই রামকৃষ্ণ মিশনে। ধর্মান্ধতা এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছে, শ্রীরামকৃষ্ণ পরিমণ্ডলের যেসব মানুষ তার সমন্বয়ী চেতনাকে বুকে লালন করেন, এই আধিপত্যবাদকে হিন্দুধর্ম বলতে অস্বীকার করছেন, তাদের কার্যত 'অহিন্দু' বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে।

জন্মসূত্রে হিন্দু, কিন্তু সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদে বিশ্বাসী নন। রামকে ঘিরে আধ্যাত্মিক চেতনা ইতিবাচক। কিন্তু দশরথনন্দনকে কোনো অবস্থাতেই কার্যত বিজেপির রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির উপায় হিসেবে মানেন না। সংখ্যালঘুর অধিকারে বিশ্বাস করেন। সহ-নাগরিক হিসেবে মুসলমান সমাজের মানুষ অর্থনৈতিক-সামাজিক-ধর্মীয়-রাজনৈতিক- সাংস্কৃতিক অধিকার নিয়ে পূর্ণ মর্যাদায় ভারতের নাগরিক হিসেবে পরিগণিত হবেন- এই ভাবনায় যারা বিশ্বাসী, তারা জন্মসূত্রে হিন্দু হলেও আধিপত্যবাদী সংখ্যাগুরু আগ্রাসনের এই রাহুকালে আজ ক্রমেই সেসব মানুষের বিশ্বাস বিপন্ন হওয়ার মুখে।

এ অবস্থায় ভারতের মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ কেমন আছেন, কতটা যন্ত্রণার বিষ কণ্ঠে ধারণ করে নীলকণ্ঠ হয়ে আছেন- তা যে কোনো সংবেদনশীল মানুষই সহজে বুঝতে পারবেন। যন্ত্রণা এখানেই বোঝার মতো মস্তিস্ক ভারত থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। উপলব্ধি করার মতো হৃদয় কার্যত উধাও। চোখে যেন ঠুলি। আর কানে যেন তালা। আর মুখ? সেখানকার বন্ধ তালা খোলার চাবি তো সেই কবেই হারিয়ে গেছে।

লেখক, পশ্চিমবঙ্গনিবাসী ভারতীয় ইতিহাসবিদ

আরও পড়ুন

×