ধর্ষণ এবং সামাজিক ব্যবস্থা

ড. কাজী ছাইদুল হালিম
প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২০ | ০৯:৪৪ | আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২০ | ০৯:৪৫
পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক এই ত্রিবলয়ে নারীরা যে হরহামেশাই হেনস্থা, শ্নীলতাহানি এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্ষণচেষ্টা বা ধর্ষণের শিকার হয় তার খবর আমরা নিত্যদিনই সংবাদমাধ্যমে দেখি, শুনি অথবা পড়ি। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো- ইদানীং আশঙ্কাজনকভাবে নারী ধর্ষণের ঘটনা বাংলাদেশে বেড়ে গেছে। নারীর ওপর পারিবারিক অত্যাচারের প্রাচীন ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগে। সে সময় পরিবারে কন্যাসন্তানের জন্ম হলে অনেক সময় তাকে জীবিত কবর দেওয়া হতো। সময়ের পরিক্রমায় কন্যাসন্তানকে জীবিত কবর দেওয়া প্রথার বিলোপ ঘটেছে সত্য, তবে অনেক পরিবারে এখনও কন্যাসন্তানের জন্ম খুব একটা সুখকর ঘটনা নয়। এক্ষেত্রে কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ায় দোষের ভাগ বহন করতে হয় অনেক মাকে। প্রথম সন্তান কন্যা হলে তো কথাই নেই, অনেক পরিবারে দুঃখের ছায়া নেমে আসে এই ভেবে যে দ্বিতীয় সন্তানটাও যদি মেয়ে হয়। অধিকন্তু, অনেক সময় অনেক পরিবারে এটাও দেখা যায় যে, নারীরা যখন পর্যায়ক্রমে কন্যাসন্তানের জন্ম দেন তখন বংশে বাতি দেওয়ার জন্য ছেলে সন্তানের জন্ম না দেওয়ার দোষও তাদের কাঁধে নিতে হয়। অনেক সময় কোনো কোনো পুরুষ আবার ছেলে সন্তানের আশায় দ্বিতীয় বিয়েও করেন প্রথম স্ত্রী রেখে অথবা প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে। এক্ষেত্রে দোষের ভাগিদার না হয়েও নারীকে নিতে হয়।
যে কোনো সন্তানের জন্ম প্রক্রিয়ায় সর্বপ্রথম যা প্রয়োজন তা হচ্ছে মা এবং বাবার শারীরিক মিলন। অনাগত সন্তান পুত্র না কন্যা হবে তা পুরোটাই নির্ভর করে বাবার ওপর, কোনোক্রমেই মার ওপর নয়। আরও বলব, এটা পুরোটাই একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার যে অনাগত সন্তান কন্যা না পুত্র হবে। প্রজনন শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে আমরা অনাগত সন্তানের লিঙ্গ-সংক্রান্ত ভ্রান্ত ধারণার অবসান ঘটাতে পারি। সাম্প্রতিককালে দৃষ্টিভঙ্গির অনেক পরিবর্তন হয়েছে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে এবং শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মাঝে। তবুও অনেক পরিবারে এখনও দেখা যায়, কন্যাসন্তান জন্মের পর তার শিক্ষা এবং ভবিষ্যৎ পেশা-সংক্রান্ত ব্যাপারে পরিবারের কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকে না এই ভেবে যে, সে তো একদিন বড় হয়ে বিয়ে হলে পরের ঘরে চলে যাবে। এভাবে অনেক ক্ষেত্রে মেয়েরা কিন্তু নিজ পরিবারেই সর্বপ্রথম লিঙ্গবৈষম্যের শিকার হয় যেটা ছেলেরা হয় না।
অর্থনীতির মূল ভিত্তি যে সব সমাজে প্রাথমিক খাত বা কৃষি (ফসল এবং পশুপালন), খনন (কয়লা এবং লোহা), খনিজদ্রব্য উত্তোলন (তেল এবং গ্যাস), মৎস্য আহরণ এবং বনায়ন সে সমাজগুলো সাধারণত পুরুষতান্ত্রিক হয়ে থাকে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পুরুষ কর্তৃত্ব; সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে পুরুষের অবাধ বিচরণ পরিলক্ষিত হয়, হোক সেটা ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি বা জনপ্রতিনিধিত্ব। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অধিকার সুরক্ষিত হয় পুরুষসৃষ্ট আইনকানুন দ্বারা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষদের চিন্তাভাবনা অনেকটাই এমন যে, 'পুরুষরা শক্তি ও ক্ষমতার প্রতীক, অপরদিকে নারীরা আদর ও যত্নের প্রতীক।' বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা সাধারণত এমন ধারণা দেয় যে, মেয়েরা দুর্বলতার প্রতীক, বিশেষ করে পারিবারিক বলয়ে। পরিবারের প্রথম সন্তান ছেলে হলে অনেক পরিবার আর দ্বিতীয় সন্তান নিতে চায় না, এই ভেবে যদি দ্বিতীয় সন্তানটা মেয়ে হয়।
কর্মক্ষেত্রে নারী কিন্তু কর্মক্ষমতার বা কর্মসম্পাদনের দিক দিয়ে কোনো অংশেই কম নয় পুরুষের সঙ্গে তুলনা করলে। অধিকন্তু, নারীরা সাধারণত পুরুষের তুলনায় সৎ, স্বজ্ঞাত এবং জীবন সম্পর্কে বেশি চিন্তাশীল হয়ে থাকে। ওই যে পারিবারিক বলয় থেকে অনেকের শিক্ষা নারীরা দুর্বল। তারাই সমাজকে কলুষিত করে নারী নির্যাতনের মতো কর্মসম্পাদন করে, ধর্ষণ করে। নারী নির্যাতন এবং বিশেষ করে ধর্ষণবিরোধী কঠোর আইন করতে হবে। আবার এসব আইনের বিচক্ষণ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, যেন পুরুষরা মিথ্যা যৌতুক এবং ধর্ষণের মামলায় হয়রানি না হয়।
বাংলাদেশে প্রাপ্ত এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক অনেক নারীই ধর্ষণের শিকার হয়, এমনকি ছোট ছেলেরাও অনেক ক্ষেত্রে বলাৎকারের শিকার হয়। সুতরাং যৌন নির্যাতনের শিকার থেকে নারী এবং পুরুষ (এ ক্ষেত্রে ছেলে শিশু) কেউই বাদ যাচ্ছে না। এটা ভাবতে আরও অবাক লাগে যখন দেখি যে তাদের ধর্ষণ করে বা তাদের বলাৎকার করে অনেক সময় তাদেরই শিক্ষা দানে নিয়োজিত গুরুজন, শিক্ষক অথবা হুজুর। প্রতিটি বোর্ডিং এবং নন বোর্ডিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (স্কুল, কোচিং সেন্টার, মাদ্রাসা এবং এতিমখানা) বসবাসরত অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে এবং মেয়ে শিক্ষার্থীদের যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের হাত থেকে সুরক্ষার জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং একই সঙ্গে জনসচেতনতাও বাড়াতে হবে।
আর্থসামাজিক এবং ধর্মীয় কারণে আমাদের দেশে প্রজনন অঙ্গ সাধারণত আলোচনার গণ্ডির মধ্যে কখনই আসে না। এটাকে এতই গোপন অঙ্গ হিসেবে গণ্য করতে শিক্ষা দেওয়া হয় যে, এটির নামও মুখে আনা পাপ এমন ধারণার জন্ম হয় মানুষের মাঝে। অনেক সময় এজন্যই অনেকে যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ বা বলাৎকারের মতো ভয়াবহ ঘটনার পরও লোকলজ্জার ভয়ে কাউকে কিছু বলতে বা জানাতে চায় না। বাস্তবতার নিরিখে এটা এখন অতি জরুরি হয়ে পড়েছে যে শিশু শ্রেণি বা প্রথম শ্রেণি থেকেই সকল শিক্ষার্থীকে তাদের শরীর সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেয়া উচিত এবং একই সঙ্গে এটাও বলা উচিত যে কখন এবং শরীরে কী ঘটলে তাদের নিজ অভিভাবককে কাল বিলম্ব না করে জানাতে হবে। শিশুদের আরও শেখানো হোক যে বড়দের করা 'কোনটা ভালো স্পর্শ আর কোনটা খারাপ স্পর্শ।' বারণ করুন পরিবারের একান্ত ঘনিষ্ঠ সদস্য ছাড়া অন্য যে কাউকে আপনার সন্তানকে স্পর্শ না করতে।
বাংলাদেশের দরিদ্র এবং অসচ্ছল পরিবারের প্রাপ্ত এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের একটা বড় অংশ এখন আমাদের উদীয়মান রেডিমেইড গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত। অনেক সময় বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের এই যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন তার মূলে রয়েছে এই দরিদ্র এবং অসচ্ছল পরিবারের মেয়েদের নিপুণ হাতের কর্মে তৈরি করা রপ্তানিযোগ্য পোশাক। হরহামেশাই আমরা শুনতে পাই যে রেডিমেইড গার্মেন্টস শিল্পে কাজ করতে এসে অনেক নারীই অনেক সময় শ্নীলতাহানি, যৌন নির্যাতন এবং ধর্ষণের শিকার হয়। কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে সেসব পরিবারকে যারা দরিদ্র এবং অসচ্ছল পরিবারের প্রাপ্ত এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের গৃহপরিচারিকার কর্মে নিয়োগ করে শ্নীলতাহানি, যৌন নির্যাতন এবং ধর্ষণের মতো কাজ করে। আবার অনেক সময় ধর্ষণ করে মেরে ফেলে আত্মহত্যা নাম দিয়ে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।
আমাদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দ্রুত পরিবর্তন আসছে। এর ফলে গতানুগতিক আয়োজিত বিয়ে ব্যবস্থাতেও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাই আজকাল অনেক ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েরা অভিভাবকের পছন্দের পরিবর্তে নিজেরাই নিজেদের জীবনসঙ্গী বেছে নিচ্ছে। বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে। এখানে দোষের কোনো কারণ নেই। ভালোইতো হচ্ছে, এতে অভিভাবকদেরও একটা বাড়তি কাজ কমছে। অভিভাবকরা সব সময়ই সন্তানদের মঙ্গল কামনা করেন, তাই উপযুক্ত জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার ব্যাপারে তারা সব সময়ই পরামর্শ দিতে পারেন, আর দিতে হবেও। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন গতানুগতিক আয়োজিত বিয়ে ব্যবস্থার আস্তে আস্তে বিলোপ ঘটাবে বাংলাদেশে, এটা আমাদের মেনে নিতে হবে। এমতাবস্থায় প্রাপ্তবয়স্ক নারীরা নিজ পছন্দে বিয়ে করতে গিয়ে যেন হবু জীবনসঙ্গীর দ্বারা শ্নীলতাহানি, যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের শিকার না হন তা থেকে রক্ষা করতে হবে। আবার একই সঙ্গে এটাও দেখতে হবে যেন আমাদের প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষরা প্রেমিকার সঙ্গে ব্রেকআপের জন্য মিথ্যা ধর্ষণের অভিযোগে কারাবরণ করতে না হয়।
আমাদের সমাজ, আমাদের বাংলাদেশ, হোক নিরাপদ আবাসস্থল নারী-পুরুষ, প্রাপ্ত-অপ্রাপ্তবয়স্ক, যুবক-বৃদ্ধ, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান এবং সকল পেশার মানুষের জন্য। অতি স্বল্পসময়ের মধ্যে কোঠর শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক প্রতিটি ধর্ষকের এবং বলাৎকারকারীর বিরুদ্ধে।
- বিষয় :
- ড. কাজী ছাইদুল হালিম
- চতুরঙ্গ