আমজনতার 'টিভি শো'
প্রতীকী ছবি
মারুফ রায়হান
প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০২০ | ০৬:৪৮ | আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০২০ | ০৮:০৮
জীবনের সব পথ যেন এসে মিশেছে ফেসবুকে। গায়ক ইউটিউবে গান আপলোড করেই এখানে পোস্ট দিচ্ছেন। কবি বড় কাগজে কবিতা ছাপিয়ে সুখ পাচ্ছেন না, লেখাটি লিংকসহ জানাতেই হবে ফেসবুকে। নবজাতকের মুখ দেখেই সেলফি তুলে বাবা পোস্ট দিচ্ছেন ওই মহামঞ্চেই।
ওয়েবিনার মানে ভার্চুয়াল সেমিনার করছে মাথা ভারী সংস্থা, মন্ত্রী নাকি প্রতিমন্ত্রী যুক্ত হয়েছেন সেখানে, ব্যস চাই ফেসবুক প্রচারণা। গৃহিণী আহামরি পদ নয়, নতুন কিছু একটা রেঁধেছেন, তারও সচিত্র বিবরণী তুলে ধরতে হবে ওই ফেসবুক-পাত্রেই। বলছি বটে সোশ্যাল মিডিয়া, কিন্তু এটি হয়ে উঠেছে মিডিয়ার সেনসেশনাল বিগ ব্রাদার। দাঙ্গাবাজ থেকে দাতামহসিন, ধর্ষক থেকে ধর্ষণবিরোধী দর্শনের অধ্যাপক, চোরপুলিশ থেকে চারুশিল্পী- কে নেই এখানে সক্রিয়! কিন্তু দানবীয় শক্তিধর এই মাধ্যমটির যথাযথ ব্যবহার জানেন কোটি সুবিধাভোগীর কয় শতাংশ? সন্দেহ রাখি না যে, যৎসামান্যই জানেন সামান্য সংখ্যক ফেসবুকার, তবু প্রতিদিনের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ করে তুলেছেন এটিকে। ভুলিনি দেশে করোনা প্রবেশাধিকার পাওয়ার পর 'ছুটি' ঘোষিত হলে ঘরবন্দি দিনগুলোয় স্বজনদের মুখ দেখা আর গল্প করার উপকারী মাধ্যম হয়ে উঠেছিল এটি। টিভির টক শোতে কথা বলা যাদের খণ্ডকালীন পেশা, যারা গান করেন, আবৃত্তি করেন তারাও ফেসবুকের শরণ নিলেন। জীবনের স্বাভাবিকতাকে অল্প হলেও ধরে রাখা, জনসংযোগ এবং মৃত্যুভয়ে শঙ্কিত সত্তার সাময়িক মুক্তির জন্য এপ্রিল থেকে জুন প্রাণময় হয়ে উঠেছিল ফেসবুকেরই কল্যাণে, এমন ইতিবাচকতাকে মূল্যহীন ভাবছি না। মানুষের দর্শনক্ষমতা যেন বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট একটি সময়ে মোবাইলের পর্দায় বা কোনো লক্ষ্যবস্তুতে একজোড়া মনুষ্যচোখ কেবল একটি বিষয়ই দর্শনে সক্ষম, এটি আমরা মানতে চাইনি। `জুম ক্লাউড মিটিংস' নামের অ্যাপটি দেখতে দেখতে জনপ্রিয় হয়ে উঠল এই বঙ্গদেশে, এমনকি 'স্টিম ইয়ার্ড'ও।
এসব অ্যাপে ভিডিও কনফারেন্সই চলত আগে, যা করপোরেট হাউস জানত, চর্চা করত। এবার জানলেন আমজনতা। লকডাউনের ভেতর ফেসবুক মেসেঞ্জার ছাড়াও এগুলো ব্যবহার করে চলছে ভিডিও আড্ডা; যা পরে অবধারিতভাবে ফেসবুকেই প্রদর্শিত হয়েছে। ওই যে শুরুতেই বলেছি, সব পথ যেন এসে মিশেছে ফেসবুকে। কয়েকজন বন্ধু ফেসবুকে গ্রুপ খুলে নিজেদের ভেতর ভিডিও আড্ডায় যুক্ত হচ্ছেন, সেগুলো পাবলিক পরিবেশনা নয়। আর দুটি অ্যাপ ব্যবহার করে আটজন বা ততোধিক ব্যক্তির অংশগ্রহণে যা হচ্ছে তাকে 'টক শো' বা 'গানের লাইভ শো' বলাই বোধহয় যুক্তিযুক্ত হবে। (যদিও ব্যান্ডউইডথ হার্টজের হেরফেরে গানের তাল-লয়-সুর ভণ্ডুল হয়েছে প্রচুর এসব অনলাইন আয়োজনে) আমেরিকা, ফ্রান্সসহ কয়েকটি দেশে অবস্থানকারী বাঙালির কাছ থেকে এমন আড্ডায় যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছেন ঢাকাবাসী বহুজন। টিভির পর্দায় বা বড় পর্দায় কিছু দেখতে অস্বস্তি হয় না চোখে। কিন্তু মোবাইলের ছোট্ট পর্দায় একসঙ্গে আটজনের মুখ দেখা অস্বস্তিকর। চোখের ওপর চাপ পড়ে। পর্দায় কিছু দেখাতে হলে ফ্রেমিংয়ের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
প্রফেশনাল ক্যামেরাপারসনরা এটা যেমন বোঝেন, তেমনি বোঝেন অভ্যস্ত দর্শকও। অনেকেই দেখছি, টিভি টক শোয়ের সঙ্গে এসব ভিডিও আড্ডার তুলনা করেছেন। বালখিল্য সে তুলনা। করোনাকালে ঘরবন্দি মানুষ টিভি-ভিডিও বিনোদনের বাইরে নতুন এক ধরনের বিনোদন পেয়েছেন, পাচ্ছেন, এটি ঠিক। বিশেষ করে টিভি টক শোতে যাদের অংশগ্রহণের সুযোগ হয়নি আগে, কিংবা হতে পারেননি টিভি উপস্থাপক, টিভিতে গাওয়ার স্বপ্ন দেখেন যারা অলস দুপুরে, তারা এমন একটি জায়গায় নিজেদের দেখার সুযোগ পাচ্ছেন, এটাই সত্য। এককালে গড়পড়তা বাঙালির ভিডিওতে নিজেকে দেখার সুযোগ মিলত বিয়ে-উৎসবে। হাতের মুঠোর মোবাইলে মুহূর্তের মধ্যে নিজের মুখ দেখানোর কথা শোনানোর সরাসরি সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে সেটি হাতছাড়া করার নির্বুদ্ধিতা বাঙালিকে কি মানায়! তাই প্রথমে কৌতূহল, পরে নিরীক্ষা এবং সবশেষে মুহুর্মুহু একটার পর একটা উপলক্ষ বানিয়ে নিয়ে এই লোভনীয় মজার কাজে বহুজন যুক্ত হন। ফেসবুক নামক মহাবিপণিবিতানে চোখ ঝলসানো মন ভোলানো হরেকরকম মিঠাইমণ্ডার আকর্ষণ এড়ানো সহজ নয়। এই মোহ যে মহাক্ষতিকর তা বুঝতে সক্ষম বুদ্ধিমান বাঙালি, এমন ভরসা পাই না। দেখা ও দেখানোর প্রতিযোগিতায় কেউই পিছিয়ে থাকতে রাজি নন। বাংলা আপনার মাতৃভাষা, তাই বাংলায় বলা ও লেখার সহজাত গুণ আপনার করায়ত্ত। তার মানে যদি ধরেই নেন আপনিও বক্তা এবং লেখক, তাহলে কি ঠিক হবে? গৃহের সবচেয়ে ছোট নিভৃত কক্ষটিতে আমরা প্রত্যেকেই গানের কলি ভাজি, তাই বলে সবাই তো আর সংগীতশিল্পী নই। শত-হাজার জনের সামনে গান পরিবেশন করতে হলে প্রয়োজন শিক্ষা, চর্চা, সাধনা। ফেসবুক লাইভে এসে কতজন যে হাস্যস্পদ হয়ে উঠছেন, তার ইয়ত্তা নেই।
প্রযুক্তির কাছ থেকে পূর্ণ সুবিধা গ্রহণের জন্য চাই সুপরিকল্পনা, নিজেকে প্রস্তুত করে তোলা। বইয়ের পাঠক কেবল কালো অক্ষরের মধ্যেই থাকেন সন্তুষ্ট। কিন্তু জোড়া চোখের থাকে দুনিয়াজোড়া ক্ষুধা। চোখ-কানের পিপাসা ও প্রয়োজন মিটিয়েই একটি ৫০ মিনিটের লাইভ হয়ে উঠতে পারে গ্রহণীয়, আদৃত। তাই যে কোনো লাইভের আগে তার দর্শনযোগ্যতা, প্রত্যাশিত দর্শকশ্রেণি এবং নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা চাই।
একজন বেসরকারি চাকরিজীবীর মন্তব্য পেলাম অনলাইনে। তিনি বলছেন, তার ছেলে 'স্ট্রিম ইয়ার্ড' ব্যবহার করে তার সহপাঠী ও বন্ধুদের সঙ্গে লাইভ করে থাকে। তিনি নিয়মিত ছেলে ও তার বন্ধুদের এ আয়োজন ফেসবুকে দেখেন। তারা সেখানে করোনাভাইরাসসহ নানা কথার পাশাপাশি সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়েও আলোচনা করছে। কেউ কেউ আবার গান ও আবৃত্তি পরিবেশন করে। ভদ্রলোক মনে করেন- এই তৎপরতা তাদের মধ্যে জনসমক্ষে কথা বলার ভীতি দূর করবে, পাশাপাশি কীভাবে নিজের বক্তব্য গুছিয়ে সুন্দর করে বলা যায়, তারও চর্চা হবে। এমন অভিমতের নেপথ্যের সত্যটি হলো- এসব লাইভ আয়োজন অংশগ্রহণকারীদের জন্য চর্চা, মানে প্র্যাকটিস। টেলিভিশন বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, টিভি মিডিয়া চর্চার স্থান নয়, এখানে যারা আসবেন তারা হবেন প্রশিক্ষিত; শুধু সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েই সুযোগ্য মেধাবীরা টিভিতে অংশ নেবেন বা পরিবেশন করবেন। সে টক শোয়ের টক-মিষ্টি যুক্তিপূর্ণ কথাই হোক, আর হোক গান, কৌতুক কিংবা অভিনয় বা খবর পাঠ। ফেসবুক লাইভকে আমজনতা নিজেদের জন্য একান্ত টিভি শো ভাবতেই পারেন, তাতে দোষের কিছু দেখি না। তবে রুচি, শালীনতা, পরিমিতিবোধ যেন হোঁচট না খায়, সুর যেন না হয় অসুর, সেটিই বিবেচ্য। তথ্য পরিবেশনেও চাই বস্তুনিষ্ঠতা। তা না হলে বানরের হাতে কোদালের তুলনাটি সবার মনে পড়ে যেতে পারে। গণমাধ্যম ও গুণগ্রাহীদের মাধ্যমকে অভিন্ন ভাবার সুযোগ নেই।
- বিষয় :
- 'টিভি শো'
- চতুরঙ্গ
- মারুফ রায়হান