স্মরণ
মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য এক জীবন

মযহারুল ইসলাম বাবলা
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২০ | ০৩:০৯
১৭ নভেম্বর ১৯৭৬ বেদনাবিধুর একটি দিন। এ দিনে চিরবিদায় নেন মেহনতি, শ্রমজীবী, নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের কাণ্ডারি, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে আমৃত্যু আপসহীন সংগ্রামী মওলানা ভাসানী। আজ তার ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। সিরাজগঞ্জের ধানগড়া গ্রামে নিম্নবিত্ত কৃষক পরিবারে তার জন্ম। শৈশবেই পিতৃমাতৃ স্নেহবঞ্চিত-অনাথ চেগা মিয়া চাচার আশ্রয়ে এবং চাচাই তাকে প্রতিপালন করেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে তিনি বেশিদূর এগোতে পারেননি। পরে ভর্তি হন মাদ্রাসায়। ভারতের দেওবন্দ থেকে শিক্ষা সমাপ্ত শেষে হতে পারতেন মাদ্রাসা শিক্ষক, মসজিদের পেশ ইমাম-মুয়াজ্জিম, ফতোয়াবাজ কিংবা ধর্মভিত্তিক দল ও মতের সাম্প্র্রদায়িক নেতা। অথচ তিনি এর কোনোটি হননি। তার শিক্ষার বৃত্ত ও সময়কে অতিক্রম করে মানবমুক্তির সংগ্রামে যুক্ত হয়েছিলেন। তার অসীম সাহস আর নির্ভীক চেতনালব্ধ রাজনীতি যেমন আতঙ্কিত করেছিল স্থানীয় সামন্তদের, তেমনি সাম্রাজ্যবাদী চক্রকেও; পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আপসহীনতার সংগ্রাম আমৃত্যু সক্রিয় ছিল। জনগণের মুক্তিসংগ্রামে সারা জীবন অকুতোভয় মওলানা ভাসানী কখনও বিচ্যুত হননি। অবিচল ছিলেন মেহনতি মানুষের মুক্তির সংগ্রামে।
ব্রিটিশ ভারতে ইংরেজ শাসকদের অনুগত-আজ্ঞাবহ সামন্ত জমিদারবিরোধী নানা কর্মকাণ্ডের কারণে পৈতৃক ভূমি থেকে বিতাড়িত চেগা মিয়ার নতুন আশ্রয় আসামের ধুবড়ির নিকটবর্তী ভাসানচর। সেখানেও সামন্তবিরোধী লড়াই থেমে যায়নি। ভাসানচরের দারিদ্র্যপীড়িত কৃষক-শ্রমজীবী মানুষকে সংগঠিত করে জোতদার-সামন্তদের বিরুদ্ধে সফল আন্দোলনে চেগা মিয়া হয়ে ওঠেন আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। সেই থেকে পৈতৃক চেগা মিয়া নামটি ছাপিয়ে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী নামে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি আসাম প্রদেশ মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ববাংলায় ফিরে আসেন এবং দ্রুত মোহভঙ্গে মুসলিম লীগ ত্যাগ করে তারই নেতৃত্বে গঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের অপশাসন এবং শোষণের বিরুদ্ধে আওয়ামী মুসলিম লীগের লড়াই-সংগ্রামে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা ভাসানীই নেতৃত্ব দিয়েছেন। জেল-জুলুমসহ নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করেছেন, তবে আপস-সমঝোতার নজির রেখে যাননি। আন্দোলনেই মুক্তি সম্ভব, অন্য কোনো উপায়ে নয়- এই সত্যটি তিনি সারা জীবন ধারণ করেছেন। ক্ষমতার রাজনীতির শৃঙ্খলমুক্ত ছিলেন বলেই মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সারাটি জীবন অবিচল ছিলেন। কখনও আত্মসমর্পণ করেননি।
১৯৫৭ সালেই বক্তৃতা মঞ্চ থেকে পাকিস্তানি পক্ষ ত্যাগে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন- 'আসসালামু আলাইকুম'। বৈষম্যপূর্ণ পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর অধীনে পূর্ববাংলার মানুষের পক্ষে থাকা সম্ভব নয়, এই সত্যটি তিনি তখন উপলব্ধি করেছিলেন বলেই পাকিস্তানি শাসকদের উদ্দেশ্যে নির্ভয়ে ১৯৫৭ সালেই ঘোষণাটি দিয়েছিলেন। ১৯৭১-এর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি রাষ্ট্র কাঠামো থেকে পৃথক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম। কিন্তু এই স্বাধীনতা সব মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। সে কারণে স্বাধীন দেশে তার সংগ্রাম থেমে যায়নি। আমৃত্যু জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অবিচল থেকেছেন।
ইঙ্গ-মার্কিন সামরিক চুক্তি এবং যুদ্ধজোটের পক্ষাবলম্বনে দলীয় সভাপতি ভাসানী চরম ক্ষুব্ধ হয়ে ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলন আহ্বান করেন। ওই সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী সোহ্রাওয়ার্দীও মঞ্চে ছিলেন। সোহ্রাওয়ার্দীকে উদ্দেশ্য করে ভাষণে ভাসানী বলেছিলেন- 'আমার জান যায় যাবে, আমি যুদ্ধজোটের বিরোধিতা করবই। আমাকে কেউ মানাতে চাইলেও মানব না। কবর থেকে চেঁচিয়ে উঠব, না-না ওই সর্বনাশা যুদ্ধজোটের পক্ষে আমি থাকব না।'
ভাসানীর বক্তৃতা শেষে সোহ্রাওয়ার্দী পদত্যাগের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করামাত্র এক তরুণ ছুটে এসে সোহ্রাওয়ার্দীকে বলেছিলেন- 'আপনি পদত্যাগ করবেন না। আমি আপনার সঙ্গে আছি।' সেই তরুণটি ছিলেন শেখ মুজিব। পরবর্তী সময়ে তিনি 'বঙ্গবন্ধু' এবং বাংলাদেশের জাতির পিতা।
মওলানা ভাসানীর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে প্রকৃত শত্রুকে তিনি যথার্থই চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদবিরোধী তার অনড় অবস্থান সে প্রমাণই দেয়। বৈষম্যপূর্ণ সমাজ ও রাষ্ট্রের অবসানে সারাটি জীবন লড়েছেন। আত্মসমর্পণ করেননি। নিজ দলের বর্ণচোরা চরম সুবিধাবাদী ডানপন্থিদের দৌরাত্ম্যে প্রকৃত বামেরা দলে টিকতে না পেরে ভাসানীকে ডানপন্থি-সুবিধাবাদীদের হাতে একলা ফেলে জনবিচ্ছিন্ন গোপন রাজনীতিতে চলে যায়। সে কারণে একার পক্ষে ভাসানীর কাঙ্ক্ষিত সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বপ্ন পূরণের সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ন্যাপেও ভাসানী আজীবন থাকেননি। ন্যাপের সুবিধাবাদী চক্রের মতলব আঁচ করেই ন্যাপ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু দলের ঊর্ধ্বে ওঠে তিনি পরিণত হয়েছেন দল-মত নির্বিশেষে শোষিত বঞ্চিত মানুষের নেতা, বাংলার মানুষের পরম শ্রদ্ধেয় 'মজলুম জননেতা'।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত
- বিষয় :
- মওলানা ভাসানী
- মেহনতি