ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার স্মৃতি

রাজু ভাস্কর্য- ফাইল ছবি
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২১ | ০৬:০৬
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উপলক্ষে ১ জুলাই ২০১৯ লেখাটি সমকালে প্রকাশ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির শতবর্ষ উপলক্ষে আবার প্রকাশ করা হলো।
৫০ বছর বললে সময়ের ব্যবধানটি যতটা না অনুভব করা যায়, 'অর্ধশত বছর' বললে তা আরও ভালোভাবে অনুভূত হয়। আজ খুব বেশি করে অনুভব করছি যে প্রায় 'অর্ধশত বছর' আগের আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন আসলেই কত আগের কথা!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্কের শুরু ১৯৬৫ সালে; ম্যাট্রিক পাস করে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর। ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সূত্রেই মধুর ক্যান্টিনে সংগঠনের কর্মিসভা, আমতলা-বটতলার ছাত্রসভায় আমার নিত্য যাতায়াতের সূচনা হয়েছিল। ১৯৬৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি ও মুহসীন হলের ৬৬০নং রুমের আবাসিক ছাত্র হওয়ার পর সেই সম্পর্ক গভীর আত্মীয়তার রূপ নিয়েছিল। ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি নির্বাচিত হওয়ার পর, তা আরও নিবিড় হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ছাত্র আন্দোলনের কাজের পাশাপাশি মন দিয়েছিলাম লেখাপড়ায়। ক্লাস, লাইব্রেরি ওয়ার্ক, নোট তৈরি, টিউটোরিয়াল ইত্যাদি কাজে নিজেকে একাগ্রভাবেই নিয়োজিত রেখেছিলাম। অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপকদের লেকচারের বাইরেও বেশ আগ্রহ নিয়ে অন্য বিভাগের কিছু কিছু ক্লাসে শুধু লেকচার শুনতে যেতাম। দর্শন বিভাগের ড. গোবিন্দ্র চন্দ্র দেব (জিসি দেব) ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর মুজাফ্ফর আহমদ চৌধুরীর (ম্যাক স্যার) ক্লাসের লেকচার খুবই আকর্ষণীয় ছিল। শিক্ষাজীবন আর ছাত্র আন্দোলনের কাজ দুটিই সমান্তরালভাবে চলত। নানা কারণে ক্যাম্পাসে প্রায় সবার কাছেই আমি আগে ভালোভাবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলাম।
ক্যাম্পাসে সে সময় চলত আইয়ুব-মোনায়েমের পয়দা করা ছাত্র সংগঠন এনএসএফের সন্ত্রাসের রাজত্ব। ছাত্রছাত্রীদের ভয় দেখানোর জন্য তারা জ্যান্ত সাপ, হকিস্টিক, কিরিচ, ড্যাগার- এসব নিয়ে হরহামেশাই ক্যাম্পাসে হামলা চালাত। হল-হোস্টেল আক্রমণ করে আবাসিক ছাত্রদের রুমে আগুন দিত। ক্যান্টিন, মেসে বিনা পয়সায় জোর করে খাওয়া-দাওয়া করত। এদের ভয়ে সাধারণ ছাত্ররাও সবসময় তটস্থ থাকত। সবাই এদেরকে চরম ঘৃণার চোখেই দেখত। ছাত্র সংগঠনগুলো ক্যাম্পাসের ভেতরে-বাইরে বেশ বড় বড় মিছিল করত। মিছিলের পথও ছিল অনেক দীর্ঘ। এখনকার মতো মিছিল শুধু কলাভবন বা ক্যাম্পাসেই সীমাবদ্ধ থাকত না। টিভি ক্যামেরা বা ফটোগ্রাফারের মোহে মিছিল এখনকার মতো 'লম্বার চেয়ে চওড়া বেশি'ও হতো না। সাধারণত মিছিল শুরু হতো শহীদ মিনার চত্বর থেকে। তারপর পল্টন মোড়, গুলিস্তান, নবাবপুর, ইসলামপুর, আরমানিটোলা, জেলগেট হয়ে শহীদ মিনারে এসে শেষ হতো।
ষাটের দশকজুড়ে ছাত্রসমাজের শিক্ষার ন্যায্য দাবি, গণতান্ত্রিক অধিকার, জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, সাম্রাজ্যবাদী শোষণ-আধিপত্য থেকে মুক্ত প্রগতিশীল সমাজ নির্মাণ, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন দাবিতে অব্যাহত ছিল উত্তাল সংগ্রাম। তিন বছরের ডিগ্রি কোর্স বাতিল কর, রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রবীন্দ্র সাহিত্যের ওপর আক্রমণ বন্ধ কর, সাম্প্রদায়িক বই 'দেশ ও কৃষ্টি' বাতিল কর, বাঙালিকে ভুট্টা খেতে বাধ্য করা যাবে না- নানা দাবিতে একের পর এক সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল। '৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, '৬৪-র গণতান্ত্রিক আন্দোলন, '৬৬-র ৬ দফা, ছাত্রসমাজের ১১ দফা, '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান প্রভৃতি আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশ অগ্রসর হয়েছিল ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধ অভিমুখে। গড়ে উঠতে থাকা এই আন্দোলন-সংগ্রামের আঁতুড়ঘর ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এসব কাজের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার সুযোগ ও সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। ক্রান্তিকালের কারিগর হতে পারা কেবল রোমাঞ্চকরই নয়; এর গৌরবও অতুলনীয়।
'৭১-এর জানুয়ারি থেকেই আমার অনার্স পরীক্ষা চলছিল। ১ মার্চ মুহসীন হলের রুমে বসে আমি বইপত্র খুলে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় খবর এলো, ইয়াহিয়া খান ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য নবনির্বাচিত পার্লামেন্টের নির্ধারিত অধিবেশন স্থগিত করে দিয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে আমি বুঝে নিয়েছিলাম, স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। খোলা বই বন্ধ করারও সময় না দিয়ে বিদ্যুৎ বেগে তখনই বেরিয়ে পড়েছিলাম রাজপথে। তখনই শুরু করে দিয়েছিলাম সশস্ত্র সংগ্রামের প্রত্যক্ষ প্রস্তুতি কাজ। মলোটভ ককটেল হাই এক্সপ্লোসিভ, বুবি ট্র্যাম্প ইত্যাদি তৈরির প্রকাশ্য প্রশিক্ষণ চালু করা হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছিল। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে রাইফেল কাঁধে নিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের এক বিশাল ব্রিগেড বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠ থেকে বের হয়ে ঢাকা শহরের প্রধান সড়কগুলোতে সুসজ্জিত প্যারেড সংগঠিত করেছিল।
২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঙালির ওপর। শুরু হয়েছিল বর্বর 'গণহত্যা'। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছিল হানাদার বাহিনীর প্রধান টার্গেট। ক্যাম্পাসকে পরিণত করা হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে ও বধ্যভূমিতে। আমরা ভারতে চলে গিয়েছিলাম। সেখানে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ বাহিনীর যোদ্ধা হিসেবে বিশেষ গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। আমি নিজে পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টরে একজন অপারেশন কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বে ছিলাম। সে সময় আমি ছিলাম ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগণিত শিক্ষার্থী আমার সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল। অন্যান্য বাহিনীর সদস্য হিসেবেও তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে একটি বড় গেরিলা দলকে নিয়ে আমি ঢাকাকে দক্ষিণ দিক থেকে ঘেরাও করতে সক্ষম হয়েছিলাম। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল। পরদিন সকালে বুড়িগঙ্গা পার হয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে আমরা শপথ নিয়েছিলাম। এদিনই আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স এনেক্স ভবনে আমাদের গেরিলা বাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন করেছিলাম। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহেই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক বসেছিল। বৈঠকে 'লাখো শহীদের রক্তে মুক্ত স্বদেশ, এসো এবার দেশ গড়ি'- এই স্লোগানের ভিত্তিতে সার্বিক বহুমুখী কর্মকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়ার তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালগুলো ভরে উঠেছিল এই নতুন স্লোগানে।
প্রথমেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল স্বাধীন দেশের জন্য একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন বিষয়ে। সে সভাতেই শিক্ষানীতির খসড়া প্রস্তাবনা প্রণয়নের জন্য একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাত্র এক মাসের মাথায় ছাত্র ইউনিয়নের এই নিজস্ব শিক্ষা কমিশনের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দুই মাসের মধ্যে প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির খসড়া দেশবাসীর সামনে আমরা তুলে ধরেছিলাম। এই ঘটনা প্রমাণ করে- শিক্ষানীতির বিষয়টিকে আমরা স্বাধীন দেশের পটভূমিতে কত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েছিলাম। পরে এই প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি ড. কুদরাত-এ-খুদা কমিশনেও প্রেরণ করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের এপ্রিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন পূর্ণ প্যানেলে জয়লাভ করেছিল। আমি ছাত্রছাত্রীদের সরাসরি ভোটে ডাকসুর সহসভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হয়েছিলাম। সেবার দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনেই ছাত্র ইউনিয়ন জয়ী হয়েছিল। নবনির্বাচিত ডাকসু দেশ গড়ার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। নিরক্ষরতা দূরীকরণ অভিযান, ব্রিগেড আন্দোলন, ভুয়া রেশন কার্ড উদ্ধার অভিযান ইত্যাদি কর্মকাণ্ড শুরু করা হয়েছিল। গ্রীষ্ফ্মের ছুটিতে ১০-১২ জন করে কর্মী নিয়ে 'ছাত্র ব্রিগেড' গঠন করে ৪-৫ সপ্তাহের জন্য শহর ছেড়ে দলে দলে ছড়িয়ে পড়েছিল গ্রামে গ্রামে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ছাত্রদের জন্য তখন ছিল সিটের দারুণ সংকট। দ্রুত কোনো নতুন হল নির্মাণ করার মতো যথেষ্ট টাকাও ছিল না। আমরা তখন ভিসি স্যারকে বলেছিলাম, কিছু টাকা আপনি বরাদ্দ করুন। তার সঙ্গে আমাদের স্বেচ্ছাশ্রম যোগ করে অস্থায়ী কিছু টিনশেড তৈরি করে সিট সমস্যার কিছুটা লাঘব করতে চাই। ভিসি স্যার সম্মতি দিয়েছিলেন। এভাবেই ডাকসুর উদ্যোগে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের স্বেচ্ছাশ্রমে এফ রহমান হলের টিনশেড নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল।
স্বাধীনতার পরপরই দেশে বড় আকারের বন্যা ও দুর্ভিক্ষাবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। সে সময় ডাকসুর উদ্যোগে রুটি বানিয়ে বিমানবাহিনীর সহায়তায় হেলিকপ্টারে করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করা হয়েছিল। কৃষক যাতে ফসল পুনরায় ঘরে তুলতে পারে, তার জন্য রেসকোর্স ময়দান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলের মাঠে ডাকসুর উদ্যোগে বীজতলা তৈরি করে সেই চারা সরাসরি কৃষকের কাছে বিতরণ করা হয়েছিল। শিক্ষণ, শিক্ষা ভাবনা ও ছাত্রছাত্রীদের লেখা নিয়ে 'ডাকসু বার্তা' নিয়মিত প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মুক্ত স্বদেশে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বেগবান করার জন্য ডাকসুর সহযোগিতায় গড়ে তোলা হয়েছিল 'নাট্যচক্র'। বাংলাদেশের সংস্কৃতি জগতের অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তির হাতেখড়ি হয়েছিল এই 'নাট্যচক্র'কে কেন্দ্র করে।
ডাকসুর আরেকটি অনবদ্য অবদান ছিল 'অপরাজেয় বাংলা'র নির্মাণ কাজের সূচনা। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে দীর্ঘ ৬-৭ বছরে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল; যা এখনও সারাদেশের ছাত্রসমাজের দ্রোহ-সংগ্রামের প্রতীক হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক পরিবেশ উন্নত করার জন্য তৎকালীন ডাকসুর প্রয়াসের অন্ত ছিল না। ১৯৭৩-এ পরীক্ষায় নকলের বিরুদ্ধে আমরা তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিলাম। প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনা আমরা সংবাদ সম্মেলন করে প্রমাণ করে দিয়েছিলাম। এ ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে পরিবর্তন করা হয়েছিল। 'অটো প্রমোশন' বা 'পরীক্ষা পেছানো'র অযৌক্তিক দাবিকে আমরা প্রকাশ্যে বিরোধিতা ও প্রতিরোধ করেছিলাম। এসব কারণে একদল ছাত্র নামধারী নকলবাজ ডাকসু অফিসে হামলা চালিয়েছিল। 'সেলিমের কল্লা চাই' বলে তারা স্লোগান তুলেছিল। কলাভবনের করিডোরে তাদের গ্রেনেড আক্রমণে ছাত্র ইউনিয়ন নেত্রী সুলতানা আহত হয়েছিলেন। আমরা ছাত্রসমাজের কাছে আহ্বান জানিয়েছিলাম আরও মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করতে। পরাধীনতার ফলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের পিছিয়ে পড়া অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াতে হলে যে বাড়তি খাটুনি দিয়ে, এক্সট্রা সময় পড়াশোনা করে, তিন বছরের কোর্স পারলে দুই বছরে শেষ করতে হবে- সে উপলব্ধি ছড়িয়ে দিতে আমরা নিরন্তর চেষ্টা করতাম। আমি ডাকসু ভিপি থাকা অবস্থাতেই রেওয়াজ করা হয়েছিল যে, প্রত্যেক বিভাগে সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রদের ছবি নোটিশ বোর্ডে লাগিয়ে রাখা হবে। তা ছাড়া একাডেমিক বছর শুরুর প্রথম দিন ছাত্রছাত্রীরা আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান-সালাম জানাবে এবং সবাই মিলে শোভাযাত্রা করে শহীদ মিনারে গিয়ে শহীদদের উদ্দেশে পুষ্পাঞ্জলি নিবেদন করে নতুন শিক্ষা বছর শুরু করা হবে। এসব রেওয়াজ ১৯৭৫-এর পর আর অব্যাহত থাকেনি।
সে সময়টিতে বিশ্বজুড়ে 'ভিয়েতনাম' ছিল প্রত্যেক প্রগতিশীল মানুষের কাছে অতি প্রিয় একটি নাম। আর সাম্রাজ্যবাদ ছিল তীব্র ঘৃণার বস্তু। ডাকসু নেতৃবৃন্দসহ ছয়জন ছাত্রনেতাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট সে দেশে ভ্রমণের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কলাভবনের বটতলার বিশাল ছাত্র সমাবেশে দাঁড়িয়ে একটি জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে প্রবল ঘৃণায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেই আমন্ত্রণপত্রটি আমি ছাত্রছাত্রীদের উল্লসিত সম্মতিতে ছিঁড়ে ফেলেছিলাম। ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি ডাকসু ও ছাত্র ইউনিয়ন কলাভবনের বটতলা থেকে ভিয়েতনামের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সংহতি জানানোর জন্য শহরের রাজপথে একটি মিছিল বের করেছিল। কিন্তু মিছিলটি প্রেস ক্লাবের কাছাকাছি পৌঁছার আগেই পুলিশ বিনা উস্কানিতে মিছিলের ওপর গুলি চালিয়ে হত্যা করেছিল ছাত্রনেতা মতিউল ইসলাম ও মীর্জা কাদেরকে। আহত হয়েছিল অনেকে। স্বাধীন দেশে পুলিশের গুলিতে এটিই ছিল প্রথম ছাত্রহত্যার ঘটনা। এই ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে ২ জানুয়ারি দেশব্যাপী অভূতপূর্ব সফল হরতাল পালন, বঙ্গবন্ধুর আজীবন ডাকসু সদস্যপদ প্রত্যাহার ইত্যাদির মধ্য দিয়ে প্রতিবাদ-আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল। আওয়ামী লীগ পাল্টা হামলা চালিয়েও তা বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। অবশেষে সরকার নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিপ্লবী সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান, ইউএসআইএস অফিস শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে সরিয়ে দেওয়া, ভিয়েতনামকে দূতাবাস খোলার অনুমতি দেওয়া, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অপসারণ, গুলিবর্ষণের ঘটনা তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন, গুলিবর্ষণে গুরুতর আহত পরাগ মাহবুবকে সরকারি খরচে যুক্তরাজ্যে প্রেরণসহ আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা ইত্যাদি পদক্ষেপ সরকার গ্রহণ করেছিল।
'দেশ গড়া'র এসব প্রগতিশীল বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে সবাইকে সঙ্গে পাওয়া যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলে সংগঠিত হয়েছিল 'সেভেন মার্ডার'। ঘটেছিল ডাকসু নির্বাচনে ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের মতো কলঙ্কিত ঘটনা। অনাকাঙ্ক্ষিত নানা সংঘাত ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড প্রসারিত হয়ে বাড়িয়ে তুলেছিল নৈরাজ্যের সন্ত্রাসী আবহাওয়া। কলুষতার কালো থাবা ব্যর্থ করে দিচ্ছিল আমাদের 'দেশ গড়া'র সংগ্রামের মহান প্রয়াসগুলো। ১৯৭৩ সালে এমএ পরীক্ষার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার শিক্ষাজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। সঙ্গে সঙ্গেই আমি ক্যাম্পাস ও ছাত্র সংগঠনের সক্রিয় কর্মকাণ্ড থেকে বিদায় নিয়েছিলাম। 'জাতীয় ছাত্রলীগ' গঠিত হওয়ায় এবং আমাকে ডাকসুর ভিপি থেকে যেতে হয়। ১৯৭৫ সালে আমাকে অবশ্য কয়েক মাসের জন্য ক্যাম্পাসে ফিরে আসতে হয়েছিল।
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে দেশে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটানো হয়েছিল। ডাকসুর ভিপি হিসেবে এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আন্দোলন গড়ে তোলার দায়িত্ব আমি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলাম। সে জন্য প্রবল বিপদ ও ঝুঁকি উপেক্ষা করে সেদিন ঘরে ঘরে ঘুরে ঘুরে তখন কাজ করতে হয়েছিল। ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের এ কাজে তেমন বেশি পাওয়া না যাওয়ায় প্রধানত ছাত্র ইউনিয়ন এবং ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকর্মীদের ওপর নির্ভর করেই আমাদের অগ্রসর হতে হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় যেদিন প্রথম খুলেছিল, সেদিনই আমরা 'মুজিব হত্যার বিচার চাই' দাবি করে ক্যাম্পাসে ঝটিকা মিছিল করেছিলাম। ৪ নভেম্বর বটতলা থেকে নীরব মিছিল করে ৩২ নম্বরের বাসায় গিয়ে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেছিলাম।
৩ নভেম্বর সংঘটিত হয়েছিল জেল হত্যাকাণ্ড। তার প্রতিবাদে আমাদের আহ্বানে ৫ নভেম্বর অর্ধদিবস হরতাল পালন ও গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তার পরই ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলি দেশকে নৈরাজ্যের আরেক পর্বে নিয়ে গিয়েছিল। আমাদের ওপর নেমে এসেছিল চরম নির্যাতন। কিছুদিন পরই আমি গ্রেফতার হয়ে গিয়েছিলাম। ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে প্রায় দুই মাস আটক করে আমাকে চরম নির্যাতন করা হয়েছিল। তখনও আমি আনুষ্ঠানিকভাবে ডাকসুর ভিপি। তারপর ১৯৭৮-এর শেষ দিক পর্যন্ত বিনা বিচারে নিরাপত্তা বন্দি হিসেবে ঢাকা জেলে একটানা থাকতে হয়েছিল। এর মধ্যেই ডাকসুর বিলুপ্তি ঘোষিত হয়েছিল। ১৯৭৮-এ জেল থেকে মুক্তি পেয়ে আর সেভাবে ফিরে যাইনি ক্যাম্পাসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আছে; বছরে এক-আধবার সেখানে যাওয়াও হয় ঠিকই। কিন্তু ১৯৬৫-এর পর ৮-৯ বছর ধরে সেখানে যেভাবে যাওয়া হতো, এখনকার যাওয়া তেমনটি মোটেই নয়। অর্ধশত বছর আগের সেই দিনগুলো কেবলই স্মৃতি। তবে 'মনে তার নিত্য আসা যাওয়া'।
- বিষয় :
- শতবর্ষের গৌরব ঢাবি