ঢাকা রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫

বেলজিয়ামের শিক্ষা ব্যবস্থা

বেলজিয়ামের শিক্ষা ব্যবস্থা

কায়সুল খান

প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২১ | ০৩:৩৬

পশ্চিম ইউরোপের দেশ বেলজিয়াম। মাত্র এক কোটি ১৫ লাখ জনসংখ্যার দেশটি শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে উন্নতির শিখরে আসীন। বেলজিয়ামে ডাচ, ফ্রেঞ্চ ও জার্মান ভাষা ব্যবহূত হয়। ফলে এখানকার শিক্ষা ব্যবস্থাও এই তিনটি ভাষার ধারায় বিভক্ত। শিক্ষা খাতে বেলজিয়াম তাদের বার্ষিক জিডিপির ৫.৮-৫.৯ শতাংশ ব্যয় করে। যা ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে প্রায় সর্বোচ্চ। বেলজিয়ামে সাক্ষরতার হার ৯৯%। বেলজিয়ামের শিক্ষা ব্যবস্থা তদারকি করার দায়িত্ব দেশটির মিনিস্ট্রি অব এডুকেশনের। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে বেলজিয়াম ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো 'বোলগোনা প্রসেস' ব্যবহার করে থাকে।

বেলজিয়ামে তিনটি ভাষাভাষীর জনসংখ্যা থাকলেও সমগ্র দেশটিতে এসব ভাষাভাষীর জন্য একই কাঠামো শিক্ষা পদ্ধতির প্রচলন রয়েছে। বেলজিয়ামের শিক্ষা ব্যবস্থা তিনটি মৌলিক পর্যায়ে বিভক্ত। ফান্ডামেন্টাল এডুকেশন, সেকেন্ডারি এডুকেশন, হায়ার এডুকেশন। এই তিনটি পর্যায়ের শিক্ষাপদ্ধতি শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ মাতৃভাষাকেন্দ্রিক। ফলে ডাচ, ফ্রেঞ্চ কিংবা জার্মান যে ভাষাভাষীই হোক না কেন একজন বেলজিয়ান শিক্ষার্থী নিজ মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা লাভের সুযোগ পায়। বেলজিয়ামে পাবলিক স্কুলের তুলনায় প্রাইভেট স্কুলের সংখ্যা অনেক বেশি, তবে এসব প্রাইভেট স্কুল সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বেলজিয়াম তাদের শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আনে। ১৯৮৯ সালে বেলজিয়ামের শিক্ষা ব্যবস্থা দেশটির এডুকেশন ফেডারেশনের আওতায় নিয়ে আসা হয়। তখন থেকে ফেডারেশন এদেশের শিক্ষার ব্যাপারে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখার অধিকার লাভ করে।

আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরুর আগে বেলজিয়ামে শিশু শিক্ষার্থীদের প্রি-স্কুলের ব্যবস্থা রয়েছে। ২-৫ বছর বয়সী শিশুরা এই প্রি-স্কুলে গিয়ে সামাজিকীকরণ, বন্ধুত্ব, আত্মপ্রকাশ, খেলাধুলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে দক্ষ হয়ে ওঠে। বেলজিয়ামের শিক্ষা ব্যবস্থায় ছয় বছর বয়সী শিশুদের বাধ্যতামূলকভাবে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য স্কুলে ভর্তি হতে হয়। এখানে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য সময়সীমা ছয় বছর। অর্থাৎ ৬-১২ বছর বয়সী শিশুরা এখানে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে। তবে বেলজিয়ামে বাধ্যতামূলক শিক্ষা গ্রহণের সময়কাল ১২ বছর। অর্থাৎ ছয় থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত এদেশের শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়।

বেলজিয়ামের প্রাথমিক শিক্ষার ছয়টি বছরকে আবার তিনটি সাইকেলে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রথম সাইকেল প্রথম-দ্বিতীয় শ্রেণি, দ্বিতীয় সাইকেল তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণি এবং তৃতীয় সাইকেল পঞ্চম-ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত। এখানে প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষায় পড়তে ও লিখতে শেখানো হয়। এর পাশাপাশি গণিতে দক্ষ করে তোলা হয়। ভাষা ও গণিত শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা জীববিজ্ঞান, সংগীত, ধর্ম ও ইতিহাসের ওপরও পাঠ নেয়।

১২ বছর বয়সে বেলজিয়ান শিক্ষার্থীরা প্রাইমারি গ্রাজুয়েট হয়। এখন তাদের পরবর্তী গন্তব্য সেকেন্ডারি স্কুল। সেকেন্ডারি স্কুলেও ডাচ, ফ্রেঞ্চ ও জার্মান ভাষাকেন্দ্রিক ভাগ রয়েছে। একই সঙ্গে ছয় বছরের সেকেন্ডারি এডুকেশনকে বেলজিয়াম প্রাথমিকের মতো তিনটি সাইকেলে বিভক্ত করেছে। বেলজিয়ামের শিক্ষা ব্যবস্থায় সেকেন্ডারি পর্যায়ের প্রথম সাইকেল অর্থাৎ সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ভাষা ও গণিতে উচ্চতর জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের জন্য শিক্ষা দেওয়া হয়। এই পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের পছন্দ মতো বিষয় বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকে না। অন্যদিকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় সাইকেল অর্থাৎ নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের উপর্যুক্ত মৌলিক বিষয়াবলির পাশাপাশি সামাজিক বিজ্ঞান, গণিত, অর্থনীতি, ভূগোল, বিদেশি ভাষা, বাস্তবিক বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ের মধ্য থেকে পছন্দমতো বিষয় বাছাই করার সুযোগ দেওয়া হয়।

সেকেন্ডারি শিক্ষাকে বেলজিয়ামে আবার চারটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। জেনারেল, টেকনিক্যাল, ভোকেশনাল এবং আর্ট সেকেন্ডারি এডুকেশন। জেনারেল সেকেন্ডারি এডুকেশনে যেসব শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে, তাদের মূল লক্ষ্য থাকে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করার। এজন্য জেনারেল সেকেন্ডারি এডুকেশনের সিলেবাস ও কারিকুলাম একটু জটিল ও আধুনিক। এই পর্যায়ে মাতৃভাষা, বিদেশি ভাষা, গণিত, বাস্তবিক বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সামাজিক বিজ্ঞান ইত্যাদির ওপর দক্ষতা অর্জন করতে হয়। অন্যদিকে যেসব শিক্ষার্থী টেকনিক্যাল সেকেন্ডারি এডুকেশনে ভর্তি হয় তারা মূলত ব্যবহারিক শিক্ষা লাভ করে। এই ধারার শিক্ষার্থীরা ভাষা, গণিত ও বিজ্ঞানের পাশাপাশি অফিস ব্যবস্থাপনা, ট্যুরিজম, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ব্যবসায় বাণিজ্য, প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষার দক্ষতা অর্জন করে। ফলে তারা যেমন সেকেন্ডারি এডুকেশন শেষে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ পায়, তেমনি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষা অর্জনের পথও খোলা থাকে। ভোকেশনাল সেকেন্ডারি এডুকেশন মূলত ব্যবহারিক ও চাকরিকেন্দ্রিক। এই পর্যায়ের সেকেন্ডারি এডুকেশন ছয়-আট বছর মেয়াদি। ভোকেশনালে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীরা রং করা, বিল্ডিং তৈরি করা, গাড়ি সারাই করা, ইলেক্ট্রিক সংযোগ স্থাপন কিংবা স্বর্ণ-রৌপ্যের গহনা তৈরির ওপর দক্ষতা অর্জন করে। ভোকেশনালের শিক্ষার্থীদের জন্যও উচ্চতর ডিপ্লোমা অর্জনের পথ খোলা রয়েছে। সবশেষে, আর্ট সেকেন্ডারি এডুকেশনে একজন শিক্ষার্থীকে চিত্রকলা, সংগীত, নৃত্য, অভিনয় ইত্যাদি শাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করে।

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বেলজিয়ামে ডাচ ও ফ্রেঞ্চ ভাষাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত। অন্যদিকে ইংরেজি ভাষা নির্ভর উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের পথও এই দেশে খোলা। ফলে বেলজিয়ান কিংবা বিদেশি শিক্ষার্থীরা এখানে ইংরেজি ভাষায় উচ্চশিক্ষা অর্জন করার সুযোগ পায়। উচ্চশিক্ষাকে বেলজিয়ামে 'বোলগোনা' প্রসেস অনুসরণ করে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করা হয়। টারশিয়ারি স্টেজ-১ (স্নাতক), টারশিয়ারি স্টেজ-২ (স্নাতকোত্তর) ও ডক্টরাল স্টেজ। বেলজিয়ামের শিক্ষা ব্যবস্থায় ২-৩ বছর মেয়াদি স্নাতক, ২-৩ বছর মেয়াদি স্নাতকোত্তর এবং ৩-৪ বছর মেয়াদি ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ রয়েছে। এখানে উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি, বিভিন্ন কলেজ রয়েছে। যেগুলোতে মেধা ও মাধ্যমিকের ফলাফলের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীরা ভর্তির সুযোগ পায়। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের জন্য শিক্ষার্থীদের ১৮০ ক্রেডিট সম্পন্ন করতে হয়। অন্যদিকে মাস্টার্সের ক্ষেত্রে এটি ৬০ থেকে ১২০ ক্রেডিট। ডক্টরাল স্টাডিজ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বেলজিয়ামেও গবেষণা নির্ভর। এখানে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা ও তা থেকে প্রাপ্ত তথ্য উপস্থাপনা এবং ডিজিস ডিফেন্সের মাধ্যমে ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করতে হয়। বেলজিয়ামের শুধু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই ডক্টরাল ডিগ্রি প্রদান করার ক্ষমতা রাখে।

বেলজিয়ামে বেশ কিছু বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এগুলোর মধ্য অন্যতম হলো কেইউ লিউভেন ইউনিভার্সিটি, ঘ্রেন্ত ইউনিভার্সিটি, ইউসি লোভেন ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব অ্যান্তরাপ, ইউনিভাসিটি লিব্রে অব ব্রাসেলস, রিজে ইউনিভার্সিটি অব ব্রাসেলস ইত্যাদি। লিউভেন ইউনিভার্সিটি ১৪২৫ সালে স্থাপিত যা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়।

বিদেশি শিক্ষার্থীদের ইউরোপের অন্যতম গন্তব্য বেলজিয়াম। নিজ খরচের পাশাপাশি এখানে বিভিন্ন স্কলারশিপে উচ্চশিক্ষা অর্জনের সুযোগ রয়েছে। বেলজিয়ামে গভর্নমেন্ট অব ফিল্যান্ডারস মাস্টার মাইন্ড স্কলারশিপ, গেল্গাবাল মাইন্ড ডক্টরাল স্কলারশিপ, এআরইএস স্কলারশিপ ফর ডেভেলপিং কান্ট্রিস, ইরাসমাস মুন্ডাস স্কলারশিপ প্রভৃতি নিয়ে উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষার্থীদের এখানে পড়াশোনা করার সুযোগ রয়েছে। ফলে বাংলাদেশ, ভারত তথা উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানের শিক্ষার্থীরা বেলজিয়ামকে সাম্প্রতিক সময়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের ভূমি হিসেবে গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক ও প্রাইভেট একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকরা বেলজিয়ামে মাস্টার্স ও ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জনের জন্য গবেষণা করছেন।

শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বেলজিয়াম দীর্ঘদিন যাবৎ উচ্চহারে বিনিয়োগের মাধ্যমে তাদের জনগণকে শিক্ষিত, দক্ষ ও সৎ জনগোষ্ঠীতে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছে। যার ফলে ইউরোপের এই দেশটির অর্থনৈতিক, প্রাযুক্তিক ও মানব জীবনযাত্রার মানের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে। বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থী ও অভিবাসন প্রার্থীদের জন্য ইউরোপের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ বেলজিয়াম। মূলত উন্নত জীবনযাত্রার মান ও উচ্চ মানের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য মানুষ বেলজিয়ামমুখী হচ্ছে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে সক্ষম হলে বাংলাদেশও একদিন দক্ষ ও সৎ কর্মীবহুল উন্নত দেশে পরিণত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

আরও পড়ুন

×