কক্সবাজারে নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের সূত্র ধরে পর্যটন জেলার একটি বড় অপরাধচক্রের নানা তথ্য সামনে এলেও এখনও তাদের টিকিটি স্পর্শ করতে পারেনি পুলিশ। ঘটনার তিন দিন পর গতকাল শনিবার পর্যন্ত মূল আসামি আশিকুল ইসলাম আশিক ও তার গ্যাং গ্রুপের একজনকেও ধরা যায়নি। এমনকি আসামি গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে এক ধরনের ঢিলেঢালা ভাব দেখা যাচ্ছে। তবে ঘটনার পর থেকেই ওই নারীর পেশা ও চরিত্র নিয়ে কথা বলতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন তদন্তসংশ্নিষ্টরা।

এর আগে কতবার কী কাজে তিনি কক্সবাজার গেছেন- এটা প্রমাণে ব্যস্ত তারা। আসামি গ্রেপ্তারে তৎপর না হয়ে ওই নারীর চরিত্র নিয়ে অপ্রাসঙ্গিক কথা বলায় অনেকে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। মূল আসামির সঙ্গে ধর্ষণের শিকার তরুণীর পূর্বপরিচয়ের প্রসঙ্গ এনেও আসল অপরাধ আড়াল করার এক ধরনের চেষ্ট চলছে। মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে। এতে ন্যায়বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হতে পারেন ভুক্তভোগী। আর আসামিরা বড় অপরাধ করেও 'ছোট সাজা' ভোগ করে পার পাওয়ার পথ তৈরি হতে পারে। এদিকে ঘটনার পর থেকে ভুক্তভোগী নারীকে ধারাবাহিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও তার মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি প্রায় উপেক্ষিত।

অনেকে বলছেন, সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ করার পরপরই ভুক্তভোগীর মানসিক ও শারীরিক বিষয় মাথায় রেখে অত্যন্ত সংবেদনশীলভাবে বিষয়টি দেখার প্রয়োজন ছিল। কাউন্সেলিংয়ের পাশাপাশি তার চিকিৎসার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা জরুরি ছিল। সেটা না করেই নানা ধরনের প্রশ্নবাণে তাকে বিপর্যস্ত করা হয়।

ধর্ষণের শিকার ওই নারী, তার স্বামী ও শিশু সন্তান এখন কী ধরনের ট্রমার মধ্যে আছেন- এটা স্পষ্ট হয়েছে তাদের কথাতেই। গতকাল রাতে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে ওই নারীর স্বামী সমকালকে বলেন, 'আমরা কেউ ভালো নেই। আমি, আমার স্ত্রী ও সন্তান খুব অসুস্থ। কখন বাসায় ফিরতে পারব, জানি না। এখানে-ওখানে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।'

মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান সমকালকে বলেন, কক্সবাজারের ঘটনায় যেভাবে ভিকটিমের চরিত্র সামনে আনা হচ্ছে- এটা গ্রহণযোগ্য নয়। বিনা সম্মতিতে তার সঙ্গে যারা এ ধরনের জঘন্য আচরণ করেছেন; সবার আগে তাদের আইনের আওতায় আনা দরকার। ভিকটিমের পেশা কী- এটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না। একটি মেয়ে তার ছোট্ট সন্তান ও স্বামীকে নিয়ে কক্সবাজারে গিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে কেন পড়ল; কারা এর সঙ্গে জড়িত; তাদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা নিশ্চিত করতে হবে।

বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী এলিনা খান সমকালকে বলেন, নারীকে দুর্বল করার জন্য তার চরিত্র নিয়ে নেতিবাচক কথা বলা এক ধরনের অস্ত্র হিসেবে দেশে অনেক সময় ব্যবহার হয়। কক্সবাজারেও সেটা আমরা দেখলাম। মেয়েটির চরিত্র ভালো, না মন্দ- সেটা নিয়ে কেন এত টানাটানি? যারা তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছে; আগে তাদের চরিত্র নিয়ে কথা বলা উচিত। আইনে স্পষ্ট বলা আছে- জোরপূর্বক কারও সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করা যাবে না।

এলিনা খান বলেন, সম্প্রতি উচ্চ আদালত থেকেও পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়- কারও সাক্ষীর ক্ষেত্রে তার চরিত্র নিয়ে কিছু উল্লেখ করা যাবে না। বক্তব্য থাকবে মূল ঘটনাকেন্দ্রিক। এর আগেও বনানীর রেইনন্ট্রি হোটেলে ধর্ষণের ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের চরিত্র নিয়ে নানা কথা বলা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সাক্ষীরা সাক্ষ্য পর্যন্ত দিতে আসেননি।

সপরিবারে কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে ঢাকার জুরাইন এলাকার ওই গৃহবধূ সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কক্সবাজারের কোতোয়ালি থানায় করা মামলার এজাহার অনুযায়ী, কক্সবাজার শহরের লাবনী পয়েন্ট থেকে তুলে নিয়ে স্বামী ও সন্তানকে জিম্মি করে হত্যার ভয় দেখিয়ে গত বুধবার ওই নারীকে দুই দফায় ধর্ষণ করে তিন যুবক। পরে বেরিয়ে আসে- এ ঘটনার মূল হোতা আশিকুল ইসলাম আশিক। কক্সবাজার শহরের একজন চিহ্নিত 'গ্যাং লিডার' হিসেবে তার পরিচিতি রয়েছে। পুলিশের খাতায় তার বিরুদ্ধে ইয়াবা, ছিনতাইসহ নানা অপরাধের অভিযোগে ১৬টি মামলা রয়েছে।

অভিযোগ আছে, কারও কারও রাজনৈতিক আশীর্বাদ নিয়ে এত মামলা সত্ত্বেও দাপট নিয়ে চলাফেরা করত আশিক। অপরাধ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণে তার একটি বড় বাহিনীও রয়েছে। কক্সবাজারের হোটেল-মোটেলকেন্দ্রিক চাঁদাবাজির একটি অংশের নিয়ন্ত্রণ আশিক বাহিনীর হাতে। চাঁদা না দিলে পর্যটকদের জিম্মি ও মারধর করত তার বাহিনী।

ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত সুপার মো. মহিউদ্দিন সমকালকে বলেন, মূল আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হোটেল ম্যানেজারকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। আর অভিযোগকারী নারী আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। ওই নারী ও তার স্বামীর দেওয়া তথ্যে নানা গরমিল আছে। ওই নারী পর্যটক নন। গত তিন মাসে একাধিকবার তিনি কক্সবাজারে এসেছেন।

কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী সমকালকে বলেন, এরই মধ্যে প্রশাসনকে তারা বলেছেন- কক্সবাজারকেন্দ্রিক টাউট, ছিনতাইকারী, অপরাধী চক্রের তালিকা তৈরি করে দ্রুত আইনের আওতায় নেওয়া হোক। পর্যটন শহর নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ রাখা সবার দায়িত্ব।

কক্সবাজারের একাধিক নাগরিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পর্যটন শহর হলেও দীর্ঘ দিন ধরে এটি নানা ধরনের অপরাধের মূল ঘাঁটি। কক্সবাজার হয়ে এখনও দেশের অধিকাংশ জায়গায় মাদকের ছোট-বড় চালান পৌঁছে। ইয়াবা হাতবদলের প্রধান পয়েন্ট কক্সবাজার হলেও এটা নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। এমনকি বিভিন্ন হোটেলের নানা ধরনের আসর থেকে নিয়মিত চাঁদা তোলে একাধিক গ্রুপ। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত আশিকের বাহিনী। গত ১৬ ডিসেম্বর 'সীলবার বে' নামে একটি হোটেলে চাঁদার জন্য হামলা করে তার সাঙ্গোপাঙ্গ।

সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে ওই নারীর স্বামী চারজনের নাম উল্লেখ ও তিনজনকে অজ্ঞাত আসামি করে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় মামলা করেছেন। এজাহারে উল্লেখ করা চার আসামি হলো- কক্সবাজার শহরের মধ্যম বাহারছড়া এলাকার আশিকুল ইসলাম আশিক, মোহাম্মদ শফি ওরফে ইসরাফিল হুদা জয় ওরফে জয়া, মেহেদী হাসান বাবু ও জিয়া গেস্ট ইন হোটেলের ম্যানেজার রিয়াজ উদ্দিন ছোটন। তাদের মধ্যে আশিক, জয় ও বাবুর বাড়ি শহরের বাহারছড়া এলাকায়। একাধিক মামলা আছে তাদের সবার বিরুদ্ধে। কিছুদিন আগে কারাগার থেকে বের হয়ে আশিক আবার জড়িয়ে পড়ে নারীদের উত্ত্যক্ত করা, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণসহ নানা অপরাধে। এসব অপরাধের আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করা হয় শহরের আনন্দ মাল্টিমিডিয়া স্কুল ঘরকে। কক্সবাজার সদর ও রামু আসনের এমপি সাইমুম সরওয়ার কমল এবং জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি এসএম সাদ্দাম হোসাইনের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আশিকের হাস্যোজ্জ্বল ছবি রয়েছে।