- চট্টগ্রাম
- 'সন্তান বিক্রি করতে চাইনি, ঘরে খুব অভাব'
'সন্তান বিক্রি করতে চাইনি, ঘরে খুব অভাব'

স্বামী ছেড়ে গেছেন অনেক আগেই। সংসারের চাকা ঘোরাতে রোজগার করবেন, এমন কাজও খুঁজে পাননি তিনি। তাই বিক্রি করতে চেয়েছিলেন সন্তান। খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার ভাইবোনছড়া এলাকায় জীর্ণ বাড়ির সামনে মা সোনালী, পাশেই সন্তান -সমকাল
'সন্তানকে আমি অনেক ভালোবাসি। ওকে অন্য কারও কাছে দিতে চাই না। কিন্তু আমি কাজ করতে পারি না। থাকার জায়গা নেই। ভবিষ্যতের কথা ভেবে সচ্ছল পরিবারে ওকে দত্তক দিতে চেয়েছিলাম। বিক্রি করতে চাইনি। তবে দত্তক দেওয়ার সঙ্গে কিছু অর্থ হাতে পেলে আমার বেঁচে থাকার পথটাও সুগম হতো।'
অভাবের তাড়নায় শিশুসন্তানকে বাজারে নিয়ে 'বিক্রির চেষ্টা'য় আলোচিত খাগড়াছড়ির সোনালী চাকমা তাঁর ভাষায় অসংলগ্নভাবে এভাবেই ব্যাখ্যা দিয়েছেন বৃহস্পতিবারের সেই ঘটনার। তিনি এখন তাঁর সন্তানকে নিয়ে খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার ভাইবোনছড়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রাম পাকুজ্যাছড়িতে বাবার বাড়িতে আছেন। ওই ঘটনার পর তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। তাঁকে চাল-ডাল-তেলসহ কিছু অর্থ দেওয়া হয়েছে। সেসঙ্গে তাঁকে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন কেউ কেউ।
অসুস্থতাজনিত কারণে দুর্বল ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত মাঝবয়সী সোনালী অনেকদিন ধরেই কষ্টেসৃষ্টে দিনাতিপাত করছেন। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে তিনি তাঁর ছয় বছরের ছেলেকে নিয়ে খাগড়াছড়ি শহরের বাজারে যান।
তাঁর এলোমেলো ঘোরাফেরা দেখে পরিচিত একজন কথা বলে জানতে পারেন, সন্তানকে টাকার বিনিময়ে দত্তক দিতে চান তিনি। এই তথ্য ছড়িয়ে পড়তেই স্থানীয় এক বাঙালি দত্তক নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তবে জংলি টিলার লোকজন তাতে বাধ সাধেন। তাঁদের বক্তব্য, কমলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সুনীল জীবন চাকমার স্ত্রী রোজিনা চাকমা দীর্ঘদিন ধরে একটি ছেলেকে দত্তক নেওয়ার জন্য খুঁজছিলেন। এর মধ্যে কেউ কেউ আবার সোনালীকে ছেলেধরা বলে সন্দেহ করে মারতে উদ্যত হন। খবর পেয়ে রোজিনা চাকমা ইউনিয়ন পরিষদ সচিব আর্জেন্ট চাকমাকে সঙ্গে নিয়ে মাছ বাজারে যান। রোজিনার স্বামী সুনীল জীবন চাকমাও উপস্থিত হন। তাঁরা মা-ছেলেকে নিয়ে শহরের মধুপুর বাজার এলাকায় যান। পথে মৃগী রোগের প্রভাবে সোনালী জ্ঞান হারান। পরে ছেলেসহ তাঁকে দুপুরের খাবার খাওয়ানো হয়। একপর্যায়ে জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও পানছড়ি থেকে মনোনীত সাবেক জেলা পরিষদ সদস্য অনিমেষ চাকমা রিংকুও সেখানে হাজির হন। বিষয়টি ভাইবোনছড়া ইউপি চেয়ারম্যান সুজন চাকমাকে টেলিফোনে জানানো হলে তিনি সোনালীর অভিভাবকদের পাঠিয়ে দেন। তাঁরা এসে সোনালী ও তাঁর ছেলেকে পাকুজ্যাছড়ির বাড়িতে নিয়ে যান। তখন উপস্থিত সবাই কিছু অর্থ সহায়তা দেন।
এ বিষয়ে অনিমেষ চাকমা রিংকুসহ উপস্থিত অন্যদের সঙ্গে গতকাল শনিবার কথা বলে সমকাল। তাঁরা জানান, চাকমা সমাজে শিশু বিক্রির মতো জঘন্য ঘটনার কোনো নজির নেই। ঘটনাটি ভুলভাবে গণমাধ্যমে এসেছে।
সরেজমিন পাকুজ্যাছড়িতে গিয়ে জানা যায়, সোনালী অনেকদিন ধরে শিশুটির ভরণপোষণের জন্য নির্ভরযোগ্য মানুষ খুঁজছিলেন। সোনালীর ছোটভাই ভরত চাকমা বলেন, আমার বড় বোন আসলে পাগল।
সোনালী দেড় বছর ধরে তাঁর বাবার বাড়িতে ভাইদের আশ্রিত হিসেবে জীবনযাপন করছিলেন। তাঁর বাবা কালাবো চাকমা, মা কালাবি চাকমা, ভাইয়ের স্ত্রী তুংকী চাকমা ও মমতা ত্রিপুরা এবং মামি বীর রানী চাকমা জানান, বছর আটেক আগে চতুর্থবারের মতো পানছড়ির দুর্গম শনখোলা গ্রামের ওজা বুজ্যা নামে এক প্রবীণ বৈদ্যকে বিয়ে করেন সোনালী। সেই ঘরের একমাত্র সন্তান রামকৃষ্ণ চাকমা। সোনালী প্রথম বিয়েতে একক সংসার করতে পারলেও পরের তিনটি সংসারেই সতিন বা বিপত্নীক স্বামীই তাঁর ভাগ্যে জুটেছে। প্রথম ঘরের সন্তানরা সচ্ছল হলেও কেউ তাঁর দেখভাল করেন না। ফলে তিনি আশপাশের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অনাহুতভাবে গিয়ে সেখান থেকে আনা খাবার বা চাল-ডাল দিয়ে কোনো রকমে চলতেন। কখনও কখনও ভিক্ষাও করতেন।
ভাইয়ের স্ত্রী তুংকী বলেন, আমরা নিজেরাই ঠিকমতো চলতে পারি না। তাই তাঁকে ও তাঁর ছেলেকে পালন করা কষ্টকর।
ওই বাড়ির একপ্রান্তে দেখা যায়, সোনালীর জরাজীর্ণ কুঁড়েঘর। একপাশে গরুর গোয়াল, আর অন্যপাশে সোনালীর রান্নার চুলা, শোয়ার খাট, লাকড়ি আর স্তূপাকার সংসারের অন্যান্য সামগ্রী।
নিজের শিশুসন্তানকে কেন বিক্রি করতে চাইলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে অসংলগ্নভাবে সোনালী জানান, কোনো সংসারেই একটু শান্তি পাননি। নিজের পেটে ধরা সন্তানরাও তাঁর দেখভাল করেন না। কোথাও একটু থাকার জায়গা পাচ্ছেন না। কাজকর্মও করতে পারেন না। তাই সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে দত্তক নেওয়ার মানুষ খুঁজছিলেন।
ভাইবোনছড়া ইউপি চেয়ারম্যান সুজন চাকমা জানান, খবর পেয়ে শুক্রবার দুপুরে নারী এমপি বাসন্তী চাকমা কয়েকজন সাংবাদিক নিয়ে সোনালীর বাবার বাড়িতে যান। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ৬০ কেজি চাল, দুই লিটার তেল, দুই কেজি ডাল ও তিন পদের মসলাসহ কিছু নগদ টাকা দিয়েছেন।
বাসন্তী চাকমা জানান, অসুস্থতা ও আয় না থাকার কারণে সোনালী মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তাই ছোট্ট শিশুটিকে দত্তক দিতে চেয়েছিলেন। শিশুটিকে সরকারি শিশুসদনে দেওয়া যায় কিনা সেটি আমরা দেখব। একই সঙ্গে সোনালীকে একটি সরকারি ঘর বরাদ্দ দেওয়ার চেষ্টা করব।
মন্তব্য করুন