দুই ‘বড় ভাইয়ের’ প্রশ্রয়ে বেপরোয়া ওরা

সারোয়ার সুমন ও মারজান আক্তার, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের এতটা বেপরোয়া হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে দুই বড় ভাইয়ের প্রশ্রয়। এদের একজন সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন আর অন্যজন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। এই দুই নেতার অনুসারীরাই দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে নৈরাজ্য চালাচ্ছে চবিতে। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, যৌন হয়রানি, অপহরণ, হল দখল ও মারধরের ঘটনায় বারবার নাম আসছে উভয় পক্ষের। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষ বারবার সংঘর্ষে জড়িয়েছে। এতে বারবার অশান্ত হচ্ছিল দেশের অন্যতম বৃহত্তম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি।
অবশ্য দুই নেতাই চবিতে তাদের সম্পৃক্ততা থাকার কথা বারবার অস্বীকার করে এসেছেন। কিন্তু গন্ডগোলের মূলে থাকা সাত-আট নেতার সঙ্গে তাদের দহরম-মহরম সম্পর্ক দেখা গেছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। দুই নেতার ছবি দিয়ে ক্যাম্পাসে আছে ছাত্রলীগ নেতাদের ব্যানার, পোস্টার ও দেয়াল লিখন।
প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারাও বলছেন, বড় দুই নেতার প্রশ্রয় থাকায় দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে পারছেন না তারা। গত ১৪ বছরে শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিভিন্ন ঘটনায় ১৯০ জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে লোক দেখানো বহিষ্কার করে প্রশাসন। কিন্তু আজীবন বহিষ্কার করার মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে খুব কম ক্ষেত্রেই। শাস্তির বিষয়টি আলোচনায় এলেই সক্রিয় হয়ে ওঠেন বড় দুই নেতা। এ কারণে বেশ কয়েকবার সাময়িক বহিষ্কার করে আবার তা প্রত্যাহার করেছে প্রশাসন।এদিকে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগও চবিতে কমিটি গঠন করতে গিয়ে বেকায়দায় পড়ে সবসময়। বড় দুই নেতাকে সন্তুষ্ট রেখে বারবার কমিটি দিয়েছে তারা। এ জন্য টানা চারটি কমিটির কার্যক্রম বিলুপ্ত করার মতো বিরল রেকর্ডও হয়েছে চবিতে। সর্বশেষ রোববার সংঘর্ষের ঘটনায় চবি ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। চবির প্রক্টর ড. নূরুল আজিম সিকদার বলেন, ‘ছাত্রলীগে বিভিন্ন গ্রুপ-উপগ্রুপ রয়েছে। তারা প্রায়শই কোন্দলে লিপ্ত হচ্ছে। এটা নিয়ে প্রশাসনও বিব্রতকর অবস্থায় আছে। তাদের এ সমস্যা সমাধান না হলে সংঘাতও কমবে না। তাদের শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে মূল ভূমিকা রাখতে হবে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকে।’
নেপথ্যে দরপত্র নিয়ন্ত্রণ
চবির বিভিন্ন হলের নির্মাণকাজ চলছে। প্রায় ৩০০ কোটি টাকার এই কাজ নিয়ন্ত্রণে নিতে অস্ত্রের মহড়া দিতে থাকে ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপ। এ নিয়ে একের পর এক সংঘর্ষে জড়াতে থাকে বিভিন্ন গ্রুপ। আগে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দুটি গ্রুপ থাকলেও ১৪ মাস আগে সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের পর সহসভাপতি ও যুগ্ম সম্পাদক পদমর্যাদার নেতারাও গ্রুপ সৃষ্টি করে কোন্দলে লিপ্ত হতে থাকে।
সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার মতো ঘটনাও ঘটিয়েছে তারা। একাধিকবার শীর্ষ পদধারীদের ধাওয়াও দেওয়া হয়েছে ক্যাম্পাসে। চাঁদা না পেয়ে কয়েকটি হলের নির্মাণকাজ বন্ধও করে দেয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ কারণে কয়েকটি হলের নির্মাণকাজ শেষ করা যায়নি নির্ধারিত সময়ে।
চার কমিটি বিলুপ্ত
২০০৪ সালে গঠিত চবি ছাত্রলীগের কমিটির নেতারা বারবার সংর্ঘষ ও মারামারিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এ কারণে এই কমিটি ২০১১ সালে বিলুপ্তি হয়। পরবর্তী কমিটি গঠিত হয় ২০১১ সালের জুনে। ২০১৪ সালের জুনে এই কমিটিও বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়। প্রায় এক বছর কমিটিহীন থাকার পর ২০১৫ সালের জুলাইয়ে দুই সদস্যবিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করা হয়। সংঘর্ষ-সংঘাত ও বিভিন্ন অভিযোগে সেই এই কমিটি দুইবার স্থগিত হয়।
২০১৬ সালের জুলাইয়ে ২০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়। বারবার সংঘর্ষের কারণে পরের বছরের মে মাসে এ কমিটি স্থগিত করা হয়। স্থগিত রাখার পরও সংঘর্ষ না থামায় ওই বছরের ডিসেম্বরে কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। এরপর ১৮ মাস কমিটিহীন ছিল চবি শাখা ছাত্রলীগ। পরে ২০১৯ সালের জুলাইয়ে রেজাউল হক রুবেলকে সভাপতি ও ইকবাল হোসেন টিপুকে সাধারণ সম্পাদক করে নতুন কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০২২ সালের জুলাইয়ে ৩৭৬ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। বারবার সংঘর্ষ ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে গত রোববার এই কমিটি বিলুপ্তি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। বারবার কমিটি বিলুপ্তির বিষয়ে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এইচ এম ফজলে রাব্বী বলেন, ‘গঠনতন্ত্র না মেনে কমিটি গঠন করা ও কেন্দ্রীয় নজরদারির অভাবে এমনটা ঘটেছে। অছাত্রদের কমিটিতে রাখা ও গঠনতন্ত্র না মেনে বিশাল কমিটি তৈরি ও বিভিন্ন গ্রুপিংয়ের কারণে সংঘর্ষের রাজনীতি দেখা গেছে।
বারবার সাংবাদিক হেনস্তা
গত দুই বছরে ১০ বারের বেশি সাংবাদিকরা হেনস্তার শিকার হয়েছেন চবিতে। নির্যাতন থেকে বাদ যাননি নারী সাংবাদিকরাও। এসব ঘটনার একটিরও সুষ্ঠু বিচার করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সর্বশেষ রোববার দৈনিক প্রথম আলোর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মোশাররফ শাহকে মারধর করে তারা। এর আগে দৈনিক সমকালের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মারজান আক্তার হেনস্তার শিকার হন। এর মধ্যে একটি ঘটনায় দুই ছাত্রলীগ নেতা খালেদ মাসুদ ও আরাফাত রায়হানকে ছয় মাসের জন্য বহিষ্কার করা হয়। তবে এই বহিষ্কার শুধু কাগজে-কলমেই। নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছেন তারা।