- মন্তব্য
- 'আইকিউ এয়ারের রিপোর্ট নিয়ে সন্দেহের সুযোগ নেই'
দূষিত বায়ুর দেশ
'আইকিউ এয়ারের রিপোর্ট নিয়ে সন্দেহের সুযোগ নেই'

অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার
বিশ্বে দূষিত বায়ুর দেশের এক তালিকায় প্রথমেই উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম। বায়ুদূষণ এবং বায়ু পরিশোধন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা সুইস সংস্থা আইকিউ এয়ারের সদ্য প্রকাশিত একটি রিপোর্টে এ তথ্য দেওয়া হয়েছে। বাতাসের মধ্যে পিএম-২.৫ (PM2.5) নামে পরিচিত এক ধরনের পার্টিকল বা সূক্ষ্ম কণার উপস্থিতি হিসাব করে এ রিপোর্টটি তৈরি করা হয়েছে। এ ধরনের রিপোর্ট কতটা গ্রহণযোগ্য এবং বায়ূদূষণ রোধে কী করা যায় সে ব্যাপারে সমকাল অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আহমাদ কামরুজ্জামান মজুমদার
আইকিউ এয়ারের রিপোর্ট নিয়ে সন্দেহের কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশ তথা ঢাকায় যে বায়ুদূষণের মাত্রা সহনসীমার বাইরে এটা নিয়ে গবেষণার দরকার নেই, এটা সবারই জানা।
সাধারণত মনিটরিং, এয়ার কোয়ালিটি ইনটেক্স, সলিউশন স্টাডির ভিত্তিতে এ ধরনের গবেষণার প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত কারণে আমাদের সব ধরনের গবেষণার সুযোগ কম। তবে পানিতে আর্সেনিক আছে কিনা তা জানতে গবেষণাগারে পরীক্ষার প্রয়োজন হলেও বাতাসে দূষণ আছে কীনা তা জানতে এমন পরীক্ষার দরকার হয়না। খালি চোখেই এই দূষণ দেখা যায়।
এ কারণে সুইস সংস্থা আইকিউ এয়ারের মতো আন্তর্জাতিক কোনো গবেষণাপত্রে যদি বাংলাদেশের বায়ুদূষণের কথা উল্রেখ করা হয় তাহলে তা গ্রহণ করে নিতে হবে।
২০১৬ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর, যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থা ইপিএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার আওতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে বায়ুর মান পরীক্ষা করা হয়। এতে দেখা যায়, ঢাকায় বায়ুদূষণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৪ থেকে ৫ গুণ বেশি। যেখানে পার্টিকল বা সূক্ষ্ম কণার পরিমাণ বছরের গড় হিসাবে প্রতি ঘনমিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম থাকার কথা সেখানে এই পরিমাণ পাওয়া যায় ৭০ থেকে ৮০ আইক্রোগ্রাম। যা সহনীয় মাত্রার চেয়ে প্রায় ৬ গুণ বেশি।
আবার শুস্ক মৌসুমে পিএম-২.৫ এর গড় মাত্রা হয় ১৫০ থেকে ২৫০ মাইক্রোগ্রাম। যা সহণীয় মাত্রার চেয়ে ১৫ গুণ বেশি। শুধুমাত্র নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি এই চার মাসে এই মাত্রা ৬০ ভাগ বেড়ে যায়। আবার বর্ষা মৌসুমে অর্থাৎ জুন-জুলাই মাসে এই মাত্রা কম থাকে। তখন বৃষ্টিপাত হওয়ার কারণে বাতাসে পিএম-২.৫ এর মাত্রা সহনীয় মাত্রার চেয়ে মাত্র ২ থেকে ৩ গুণ বেশি থাকে।
আশার কথা হলো, ২০২০, ২০২১ সালে কারোনাকালীন জুলাই মাসে ঢাকার বাতাসে পিএম-২.৫ মাত্রা অনেক কমে গেছিল। বিশেষ করে ২০২১ সালের জুলাইয়ের ৪-১২ ও ২১-৩০ তারিখ পর্যন্ত লকডাউন,ঈদের ছুটি ও বৃষ্টিপাত হওয়ার কারণে বাতাসে ধুলিকণার পরিমাণ ১০ মাইক্রোগ্রামে নেমে আসে। এটা শুধুমাত্র ইউরোপ, আমেরিকা বা উন্নত বিশ্বের বড় বড় শহরে দেখা যায়।
এ ধরনের রিপোর্ট থেকে এটাই বোঝা যায়, চাইলেই ঢাকার বাতাস নির্মল করা সম্ভব। প্রতি বছর আমাদের দেশে বায়ুদূষণজনিত রোগে ১ লাখ ৩০ হাজার মানুষ মারা যায়। আমরা যদি শুধু শুষ্ক মৌসুমে বায়ুদূষণ রোধ করতে পারি তাহলে এত মৃত্যু রোধ করা যায়।
ঢাকা শহরে ৮০ ভাগ মানুষ যাতায়তের জন্য গণ পরিবহন, রিকশা ব্যবহার করে ও হাঁটে। অন্যদিকে মাত্র ২০ ভাগ মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে। তাই ক্ষতিকর গ্যাসের নিঃসরণজনিত বায়ুদূষণ কমাতে গণপরিবহনের ব্যবহার বাড়াতে হবে।
ইটের ভাটার কারণে বায়ুদূষণ হয়। এজন্য পরিবেশবান্ধব ইটের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
ঢাকায় চলা ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কালো ধোঁয়ার কারণে বায়ুদূষণ বাড়ে। যখনই অবৈধ বা ফিটসেবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয় তখন বায়ুদূষণ কমে যায়।
ঢাকা শহরের বায়ুর মান খারাপ হবার অন্যতম কারণ বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে সৃষ্ট ধূলিকণা। সড়কের পাশে উন্মুক্ত নির্মাণ কাজের কারণে বাতাসে ধুলিকণার পরিমাণ বাড়ছে। নির্মাণ বিধি মেনে নির্মাণ কাজ করার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের নীতিমালা থাকলেও বেশিরভাগ মানুষই তা মানছেন না। যারা এসব নীতিমালা মানছেন না তাদেরকে আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
বায়ুদূষণ রোধে একটা সমন্বয় থাকা প্রয়োজন। সিটি কর্পোরেশন, সিটি গভর্নেসকে বায়ুদূষণ প্রতিকারে ভূমিকা রাখতে হবে। তার আগে এসব সংস্থাকে এই ধরনের কাজ করার জন্য শক্তিশালী করতে হবে। ২০২১ সালে হাইকোর্ট বায়ুদূষণে কারা দায়ী তা জানতে এবং প্রতিরোধে কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন।
এর মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পানি ছিটানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেন আদালত। একই সাথে ঢাকার রাস্তায় ওপর থেকে পানি ছিটাতে সিটি করপোরেশনকে নির্দেশ দেন যাতে রাস্তার পাশের ছোটখাটো গাছে জমে থাকা ধুলা-ময়লা পরিষ্কার হয়। আবার পানির ঘাটতি তৈরি হলে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশকে পানি সরবরাহ করতে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে নির্দেশ দেন আদালত।
সবাই একত্রিত হয়ে সমন্বিতভাবে এসব উদ্যোগ নিলে ঢাকার বায়ুদূষণ রোধ করা সম্ভব।
মন্তব্য করুন