- মন্তব্য
- আড়ি পাতার অপব্যবহার সম্পর্কে হুঁশিয়ারি
আড়ি পাতার অপব্যবহার সম্পর্কে হুঁশিয়ারি

প্রতীকী ছবি
সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদে নাগরিকদের ব্যক্তিগত ও অন্যান্য যোগাযোগের ক্ষেত্রে গোপনীয়তার অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। তবে জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নোত্তরে গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, আইনসম্মতভাবে মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেট মাধ্যমে যোগাযোগে আড়ি পাতার ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফলে সরকারের এ ধরনের উদ্যোগ নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
আইনজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার দোহাই দিয়ে আইনসম্মতভাবে আড়ি পাতার ব্যবস্থা চালু করা হলে এর অপব্যবহারের শঙ্কা রয়েছে। কারণ গত কয়েক বছরে বেআইনিভাবে যাদের ফোনালাপ ফাঁস করা হয়েছে, তারা সবাই সরকারের সমালোচক। অর্থাৎ আড়ি পাতা ব্যবস্থা চালু হলে বিরোধীদের দমনে এটি সরকারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহূত হতে পারে। তবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার কারণে যদি বিশেষ ব্যক্তির ক্ষেত্রে আড়ি পাতা হয় সেটি আদালতের মাধ্যমে হওয়া বাঞ্ছনীয়। তাছাড়া আড়ি পাতার বিষয়টি সার্বিকভাবে সংবিধান প্রদত্ত মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকেই ক্ষুণ্ণ করবে।
এর আগে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম হারেৎজ গত ১০ জানুয়ারি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ইসরায়েলের সাবেক এক গোয়েন্দা কমান্ডার পরিচালিত কোম্পানি থেকে নজরদারির অত্যাধুনিক প্রযুক্তি কিনেছে বাংলাদেশ সরকার। গত বছর বাংলাদেশে প্রায় ৬০ কোটি টাকার প্রযুক্তি আনা হয়েছে। সরকারি নথি ও আন্তর্জাতিক রপ্তানি রেকর্ডের বরাত দিয়ে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
গত এক যুগ ধরে বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তিগত ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। যার অধিকাংশই রাজনীতি-সংশ্নিষ্ট বিষয়। তবে একই সময়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকসহ সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী-এমপির ফোনালাপ ফাঁসেরও ঘটনা ঘটেছে।
এসব ফোনালাপ ফাঁস হওয়ায় বিব্রত হয়েছেন সংশ্নিষ্টরা। কয়েকটি ঘটনায় সংশ্নিষ্টদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র বা সরকারের বিরুদ্ধে যড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে কারা এসব ফোনালাপ রেকর্ড করছে তাদের কখনও চিহ্নিত করা হয়নি। এসব ঘটনায় কেউ গ্রেপ্তার হয়েছে এমন নজিরও নেই। ২০২১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ফোনালাপ ফাঁস ও নজরদারি প্রসঙ্গে এক রিটের শুনানিতে হাইকোর্ট বলেন, ব্যক্তিগত বিষয়গুলোতে আড়ি পাতা যেমন ঠিক নয়, তেমনি মিডিয়া সগৌরবে সেগুলো প্রচার করে এটিও ঠিক নয়। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম (বর্তমানে আপিল বিভাগে) ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের তৎকালীন বেঞ্চ এই পর্যবেক্ষণ দেন।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ৭১ ধারা অনুযায়ী, ফোনে আড়ি পাতার অপরাধ প্রমাণিত হলে অনধিক দুই বছর কারাদ এবং অনধিক ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদ দেওয়ার বিধান আছে। তবে এই আইনে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলা স্বার্থে বিশেষ বিধানের কথাও বলা হয়েছে।
আইনের ৯৭ (ক) ধারায় বলা আছে, 'এ আইনে বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যা কিছুই থাকুক না কেন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে যে কোনো টেলিযোগাযোগ সেবা ব্যবহারকারীর প্রেরিত বার্তা ও কথোপকথন প্রতিহত, রেকর্ড ধারণ বা তৎসম্পর্কিত তথ্যাদি সংগ্রহের জন্য সরকার সময় সময় নির্ধারিত সময়ের জন্য গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা বা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থার কোনো কর্মকর্তাকে ক্ষমতা প্রদান করিতে পারিবে এবং উক্ত কাজে সার্বিক সহায়তা প্রদানের জন্য টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানকারীকে নির্দেশ দিতে পারিবে এবং পরিচালনাকারী উক্ত নির্দেশ পালন করতে বাধ্য থাকিবে।' বিদ্যমান আইনি কাঠামোতে বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলার প্রয়োজনে আড়ি পাতার মতো কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।
ইসরায়েল থেকে নজরদারির প্রযুক্তি কেনার বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। প্রতিষ্ঠানটির মতে, নজরদারি-সংশ্নিষ্ট প্রযুক্তি ব্যবহারে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অনুপস্থিতিতে এমন প্রযুক্তির ব্যবহারে ব্যক্তিগত তথ্যের ব্যবহারের গোপনীয়তা, সুরক্ষা এবং বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ একাধিক সাংবিধানিক অধিকার খর্ব হওয়ার ব্যাপক ঝুঁকি তৈরি হবে।
বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক সমকালকে বলেন, 'সারাবিশ্বে কর্তৃত্ববাদী সরকারের অর্থই হলো বাকস্বাধীনতা, যোগাযোগের স্বাধীনতা, বিবেকের স্বাধীনতার মতো অধিকারগুলো খর্ব বা সংকুচিত করা। পক্ষান্তরে, গণতান্ত্রিক ও আইনের শাসনের দেশে এসব করা হয় না। কিন্তু আমাদের এখানে সরকার কর্তৃত্বকে আরও সুসংহত করতে চায়। তাই এটাই স্বাভাবিক যে, সংবিধান ও আইনের শাসন উপেক্ষা করে সরকার তার সমালোচক ও বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে বেআইনিভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করবে। তাই সরকার আগে যন্ত্রপাতি কিনেছে। এখন পছন্দমাফিক আইন করবে এবং পরে সংবাদমাধ্যমসহ সবার মানবাধিকার আরও খর্ব ও সংকুচিত করবে।' তিনি আরও বলেন, 'সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও আড়ি পাতা হয়। তবে সেই আড়ি পাতার আগে সেইসব দেশের সংশ্নিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বিষয়ে পুলিশকে আদালতের কাছ থেকে যথোপযুক্ত প্রাথমিক তথ্যাদি পেশ করতে হয়। আদালতের অনুমতি দিলে তা করা হয়। আমাদের দেশেও এ ধরনের ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। তাহলে সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত থাকবে।'
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, রাষ্ট্র্রের নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা স্বার্থে আড়ি পাতা হলে সেটা বৃহৎ স্বার্থে মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু তারও একটা কাঠামো থাকতে হবে। বেআইনিভাবে আড়ি পাতা এখনও হচ্ছে। তবে এবার সেটি আইনের আওতায় আনার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। কিন্তু সেটি যদি সাধারণভাবে ব্যবহূত হয়, তাহলে যারা এগুলো করছেন তাদের বলব, ঘরে ঘরে সিসিটিভি লাগিয়ে দিন, আড়ি পাতার প্রয়োজন হবে না। সে ক্ষেত্রে সংবিধানকে সিন্দুকে আটকে রেখে এগুলো করতে হবে। তার মতে, সাংবিধানের চেয়েও কিছু আইন দেশে শক্তিশালী হয়ে উঠছে। তবে এগুলো শেষ পর্যন্ত টিকবে না। যাঁরা করছেন তাঁরা এসব আত্মঘাতী কালো আইনের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, 'এখন যে বিধান রয়েছে অর্থাৎ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে বিশেষ ব্যক্তি যারা জঙ্গি বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে তাদের নজরদারি করা যায়। এর বাইরে গিয়ে যদি কাউকে নজরদারি করতে আড়ি পাতা হয় সেটি অবশ্যই বেআইনি। আর আইন করে যে আড়ি পাতার বৈধতা দেওয়ার কথা উঠেছে সেটি সঠিক নয়। এটি গ্রহণযোগ্য হবে না।' তার মতে, সরকার শেষ পর্যন্ত সেই পথে হাঁটবে বলে মনে হয় না।
আড়ি পাতা চালুর উদ্যোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, 'আমি সংসদে ছিলাম না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কোন প্রেক্ষাপটে কীভাবে বলেছেন, বিষয়টি আগে বুঝে নিই। আগে মন্তব্য করা ঠিক হবে না।'
মন্তব্য করুন