- অপরাধ
- মাঠ থেকে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সর্বত্র দুর্নীতি: দুদক
মাঠ থেকে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সর্বত্র দুর্নীতি: দুদক
সমকাল প্রতিবেদক |
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১
আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১
প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ । আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১
ফাইল ছবি
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, সরকারি-সেরকারি খাতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। মাঠ পর্যায় থেকে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সর্বত্র দুর্নীতি। এ দুর্নীতি থামাতে হবে।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে দুদকের গত ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর সোমবার ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে এ কথা বলেন তিনি। রোববার কমিশন রাষ্ট্রপতির কাছে বার্ষিক প্রতিবেদনটি জমা দেন।
সোমবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে ব্রিফিংকালে ওয়েবিনারে যুক্ত হন দুদক কমিশনার এ এফ এম আমিনুল ইসলাম ও ড. মোজাম্মেল হক খান।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, 'দুর্নীতি থামাতে জনগণের সোচ্চার আন্দোলন দরকার। এক্ষেত্রে সরকার, সুশীল সমাজ, এনজিও, দুদক- কেউই জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারেনি। সবাই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন। দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে যে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস দরকার সেটা কবে জেগে উঠবে- এটা দীর্ঘ সময় ধরে একটি প্রশ্ন হয়েই আছে।'
তিনি আরও বলেন, 'কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলেও এই কালো টাকার উৎস দেখে দুদক। কালো টাকা ঘুষ, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত হলে সংশ্লিষ্ট টাকার মালিক আইনের হাত থেকে রক্ষা পান না। কালো টাকার মালিকরাই স্ত্রীর নামে সম্পদ রাখেন। স্ত্রীর ব্যবসার লাইসেন্স নেই, গৃহিনী- তবু অনেক টাকার মালিক। এমনটা হলে তাদেরও অইনের আওতায় আনা হয়।'
২০১৯ সালে কমিশনের সার্বিক কার্যক্রম তুলে ধরে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, তাদের পাঁচ বছর মেয়াদের এক বছর চলে গেছে কোভিড মহামারির মধ্য দিয়ে। কমিশনের শেষ বছরটিতে দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে অনেক পরিকল্পনা ছিল। সেসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
তিনি আরও বলেন, দুর্নীতি সর্বগ্রাসী ব্যাধি। তার প্রমাণ পি কে হালদার। স্বচ্ছ মনিটরিং ব্যবস্থা ও জবাবদিহিতা না থাকায় পি কে হালদার খুব সহজেই ননব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পালিয়েছে। ননব্যাংকিং আর্থিকখাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরিং ব্যবস্থা কার্যকর করার কথা বলেন তিনি।
ইকবাল মাহমুদ বলেন, 'গ্রামে ৮০ শতাংশ মানুষ বাস করে। তাদের নিরাপদ অবস্থান বজায় রাখতে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। আর এই দুর্নীতি বন্ধের জন্য সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। সরকারি ক্যাডারদের মধ্য থেকে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিয়োগ এবং মাঠ পর্যায়ে সরকারি দায়িত্ব নবনিযুক্ত ক্যাডারদের দেওয়া হলে স্বস্তি ফিরে আসতে পারে। তারাই দুর্নীতির গোড়ায় আঘাত হানতে পারে।'
দুদক চেয়ারম্যান আরও বলেন, 'সংবিধানে উল্লেখ থাকলেও গত ঞ্চাশ বছরেও ন্যায়পাল নিযুক্ত করা হয়নি। দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে ন্যায়পালের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। গুণগতমান সম্পন্ন আমলাতন্ত্রও দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে। স্থায়ীভাবে সিভিল সার্ভিস রিফর্ম কমিশন গঠন করতে হবে। সরকারি কাজে পদ্ধতিগত পরিবর্তনের মাধ্যমে জনগণকে হয়রানিমুক্ত দ্রুত সেবা দেওয়া সম্ভব। সেটি করা জরুরি।'
ব্রিফিংকালে বলা হয়, কোনো ব্যক্তি ভুলক্রমে তার কোনো বৈধ অর্থ-সম্পদ ট্যাক্স রিটার্নে উল্লেখ না করলে সেটি কালো টাকা হয়ে যায়। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হারে জরিমানা দিয়ে সেই টাকা সাদা করা যেতে পারে। কিন্তু ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত কালো টাকা সাদা করা হলে দুদক প্রশ্ন করবে এবং আইনি ব্যবস্থা নেবে। সুশীল সমাজ এবং এনজিওর দুর্নীতির বিরুদ্ধে কৌশলগত পরিকল্পনা নেই।
এক প্রশ্নের জবাবে ইকবাল মাহমুদ বলেন, 'বেসিক ব্যাংকের টাকা কোথায় গেছে, কার কাছে গেছে সেটি এখনও নির্দিষ্ট করা যায়নি। এই কারণে বেসিক ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের ৫৬ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।'
আলজাজিরায় বাংলাদেশ সম্পর্কিত প্রতিবেদনের বিষয়ে তিনি বলেন, 'মুখের কথায় কিছু করা যাবে না। এক্ষেত্রে আমলযোগ্য দুর্নীতির প্রমাণ পেতে হবে। কেউ এ সম্পর্কিত প্রমাণ জমা দিলে সেটা পর্যালোচনা করে দেখা হবে।'
ইকবাল মাহমুদ আরও বলেন, চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ায় তিনি এবং কমিশনার এ এফ এম আমিনুল ইসলাম আগামী ১৩ মার্চ কমিশন থেকে বিদায় নেবেন। গত পাঁচ বছরে দুদকের কার্যক্রম নিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করা সাংবাদিকদের সঙ্গে তার সৌহার্দ্যপূর্ণ ভাব গড়ে উঠেছে। বিদায়ের পরও যেন এই সর্ম্পক বজায় থাকে- এই প্রত্যাশা করেন। তিক্ত কোনো অভিজ্ঞতা ভুলে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, 'আমরা সব ভালো মনে রাখব।'
দুদকের ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালে মামলা ও চার্জশিটের সংখ্যা কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পেয়েছে। মামলা ও চার্জশিটের গুণগত মান নিশ্চিত করার কারণেই কমিশনের মামলায় সাজার হার ৬৩ শতাংশে উন্নীত। কমিশন চায়, দুদকের মামলায় সাজার হার হবে শতভাগ। ২০২০ সালে কমিশনের মামলায় সাজার হার ৭৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
ব্রিফিংকালে দুদকের সচিব ড. মুহা. আনোয়র হোসেন হাওলদার, প্রতিরোধ ও গবেষণা উইংয়ের মহাপরিচালক এ কে এম সোহেল উপস্থিত ছিলেন। চেয়ারম্যান ব্রিফিং শেষে দুদক বিটের রিপোর্টার্স অ্যাগেইনস্ট করাপশনের (র্যাক) সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করেন। এ সময় র্যাকের সভাপতি মহিউদ্দীন আহমেদ ও সাধারণ সম্পদক আহমদ ফয়েজ বক্তব্য রাখেন।
র্যাকের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দুদক কম্পাউন্ডের ভেতরে সংগঠনের একটি অফিস স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চেয়ারম্যান দুদক সচিবের প্রতি নির্দেশ দেন।
বার্ষিক প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত চার বছরে কমিশন কর্তৃক অনুমোদনকৃত চার্জশিটের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০১৯ সালে ২০১৮ সালের চেয়ে চার্জশিট অনুমোদনের সংখ্যা সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে। কমিশন মানসম্মত মামলা তদন্তের বিষয়ে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করায় অভিযোগপত্রের সংখ্যা খুব বেশি বৃদ্ধি পায়নি। ২০১৯ সালে ১৬টি ফাঁদ মামলা পরিচালনা করা হয়েছে। ফাঁদ মামলা এর আগের বছরের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে।
গত পাঁচ বছরের মামলায় বিচারিক আদালতের রায়গুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দুদকের মামলায় ২০১৫ সালে সাজার হার ছিল ৩৭%, ২০১৬ সালে সাজার হার ৫৪%, ২০১৭ সালে সাজার হার ৬৮%, ২০১৮ সালে সাজার হার ৬৩% এবং ২০১৯ সালে সাজার হার ৬৩%।
এ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১৭ সাল থেকে কমিশনের দায়ের করা মামলায় সাজার হার প্রায় স্থিতিশীল রয়েছে। এটা কমিশনের ইতিবাচক অর্জন। ২০১৫ সালে যেখানে মামলায় সাজার হার ছিল মাত্র ৩৭ শতাংশ, সেখানে ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ধারাবাহিক মামলার সাজার হার ৬০ শতাংশের ওপরে। যদিও কমিশন চেষ্টা করছে, তাদের মামলায় শতভাগ সাজা নিশ্চিত করার। কমিশন কর্তৃক দায়েরকৃত মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত মামলায় শতভাগ সাজা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যাংক কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি।
এবারের প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্টভাবে ১৪টি খাত বা বিষয় ছাড়াও বিবিধ সুপারিশে ন্যূনতম ৯টি ইস্যু বা খাতভিত্তিক সুপারিশ পেশ করেছে কমিশন। এর মধ্যে উল্লেখখযোগ্য খাতসমূহ হচ্ছে- স্থায়ী সিভিল সার্ভিস সংস্কার কমিশন গঠন, আয়কর, কাস্টমস, ভ্যাট সংক্রান্ত, স্বাস্থ্যখাত, সড়কে যানবাহন ব্যবস্থাপনা, ওষুধ শিল্প, নদী দখল, নিষিদ্ধ পলিথিনের আগ্রাসন, দুর্নীতিমুক্ত ভূমি রেজিস্ট্রেশন, ইটভাটা স্থাপন সংক্রান্ত, দীর্ঘমেয়াদী নৈতিকতার বিকাশে বিএনসিসি, স্কাউটিং ও গার্লগাইডের কার্যক্রম, সরকারি পরিষেবায় মধ্যস্বত্বভোগী, ওয়াসা, ন্যায়পাল নিয়োগ, পরীক্ষার মাধ্যমে নবম গ্রেড থেকে তদূর্ধ্বো পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ইত্যাদি।
বিষয় : দুদক চেয়ারম্যান বার্ষিক প্রতিবেদন দুর্নীতি
মন্তব্য করুন