প্রতারণার টাকা জুয়ার সাইটে বিনিয়োগ, জেতার পর উত্তোলন

আব্দুর রউফ ওরফে বাপ্পি। ছবি-সমকাল
আবদুল হামিদ
প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০৫:৫০ | আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ২০:৪২
আব্দুর রউফ ওরফে বাপ্পি পারিবারিক অভাব অনটনে লেখাপড়া নিয়মিত করতে পারেনি। এ অবস্থায় গার্মেন্টসে কাজের উদ্দেশ্যে ঢাকা আসেন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতায় ঢাকা ছাড়েন অল্প দিনে। কিন্তু এই সময় অর্জিত বিদ্যা ছাড়েননি তিনি। ভুক্তভোগীদের কণ্ঠের জালে ফেলে শুরু করেন প্রতারণা। আয় করেছেন কোটি কোটি টাকাও, কিন্তু সেই টাকা খুইয়েছেন জুয়ার সাইটেই। এ ছাড়া জুয়া খেলে জেতার পর প্রতারণার টাকা নিজের হিসাব নম্বরের মাধ্যমে উত্তোলন করতেন। সম্প্রতি তাকে গ্রেপ্তার করার পর এসব তথ্য জানিয়েছেন পুলিশ। এই চক্রের আরও বেশ কয়েকজনকে সদস্যকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাপ্পি প্রতারণার টাকা নিজের কোনো ব্যাংক হিসাব নম্বর বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নিতেন না। এ পর্যন্ত সে যত টাকা প্রতারণার করেছে সব টাকাই বেটিং সাইটের মাধ্যমে নিয়েছে। তার ধারণা ছিল, এভাবে প্রতারণা করলে ধরা পড়ার কোনো ভয় থাকবে না। এভাবে প্রতারণার চার বছর পর এই প্রথম তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার একাধিক জুয়া খেলার আইডি থাকলেও একটি পাওয়া গেছে। সেখানে অল্প সময়ে ২১ লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।
বাপ্পি চাকরির কথা বলে এক ভুক্তভোগীর কাছ থেকে প্রতারণা করে লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। পরে গত ৩০ ডিসেম্বর রাজধানীর উত্তরখান থানায় বাদী হয়ে ওই ভুক্তভোগী একটি মামলা করেন। সেই মামলার তদন্ত নেমে সিটিটিসির সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ এই অভিনব প্রতারণা চক্রের সদস্য বাপ্পিকে গ্রেপ্তারের পর এসব তথ্য জানতে পারে। এ সময় তার কাছ থেকে সিমকার্ড, মোবাইল, হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর উদ্ধার করেছে।
তদন্ত কর্মকর্তা বলছেন, লেনদেনের হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা যায় গ্রেপ্তার বাপ্পি গত ২ মাসেই একটা ‘এয়ানএক্সবেটিং’ হিসাব থেকে ২১ লাখ টাকার জুয়া খেলেছেন। তার অন্যান্য সহযোগীদের শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তারা দৃশ্যমান কোনো কিছু করেন না। শুধু একটা ফার্মেসি আছে, সেখানে বাপ্পি বসে না। কিন্তু প্রতারণার টাকা দিয়ে গ্রামে বাড়ি–গাড়ি করেছেন।
তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই অজয় দাস সমকালকে বলেন, ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করতে আসে। কিন্তু কিছুদিন পর অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে ওই অবস্থায় বাড়ি গিয়ে গ্রামীণফোনের সিম বিক্রেতার কাছ থেকে কয়েকটি অন্য নামে (বেনামী) নিবন্ধিত সিমকার্ড সংগ্রহ করেন। ওই নম্বর দিয়ে শুরু করেন বায়িং হাউজে চাকরি দেবার নামে প্রতারণা। বায়িং হাউজের চাকরি সম্পর্কে ধারণা থাকায় সে বিভিন্ন কৌশলে সিভি সংগ্রহ করে, সিভির রেফারেন্সে থাকা নম্বরগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেও নতুন করে সিভি সংগ্রহ করেন।
জানা গেছে, এরপর শুরু হয় প্রতারণার প্রথম ধাপ সেই সংগৃহীত সিভির চাকরি প্রার্থীদের ফোন করে নিজেকে বিভিন্ন নামীদামী বিদেশি কোম্পানির বাংলাদেশি প্রতিনিধি বলে পরিচয় দেন। পরে কথার একপর্যায়ে আকর্ষণীয় বেতনে বায়িং হাউজের চাকরির নামে পাতেন ফাঁদ। এ সময় তাদের সঙ্গে কণ্ঠ পরিবর্তন করে হোয়াটসঅ্যাপে বিভিন্ন দেশের কান্ট্রি ম্যানেজারের পরিচয় দিয়ে কথা বলেন। ওই অবস্থায় হোয়াটসঅ্যাপে সাক্ষাৎকার (ইন্টারভিউ) নিয়ে চাকরি চূড়ান্ত (কনফার্ম) করে দিয়ে বাংলাদেশি প্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। পরে বাংলাদেশি প্রতিনিধি পরিচয়দানকারী ব্যক্তি কান্ট্রি ম্যানেজারকে তার দেশে যাবার জন্য বিমানের টিকিটসহ খরচ বাবদ কিছু টাকা পাঠাতে বলেন। কেউ এই ফাঁদে পা দিলে শুরু হয়, তার নতুন ফাঁদ।
পরে চাকরি কনফার্ম করে মূল কোম্পানিতে মেইল করা হয়েছে বলে জানায়। বিদেশি কোম্পানির বেতন নিতে হবে নেটেলার অথবা পেপাল হিসাব নম্বরে। আর এই হিসাব নম্বর তৈরি এবং চালু করার জন্য বিভিন্ন ধাপে টাকা হাতিয়ে নেয়। টাকা দিতে না চাইলে ক্যারিয়ার ধ্বংসের হুমকি দেয়। টাকা হাতানোর কৌশলও অভিনব। প্রতারক নিজের কোনো বিকাশ, নগদ অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে না, প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া টাকা ডিপোজিট করে অনলাইন জুয়াসাইট 'এয়ানএক্সবেটিং' এ। এভাবে প্রতারকচক্র গত ৪ বছরের প্রায় পাঁচ শতাধিক চাকরি প্রার্থীর সঙ্গে প্রতারণার মাধ্যমে ২ কোটি টাকার মতো হাতিয়ে নিয়েছে। প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া টাকার বেশিরভাগ সে জুয়ার সাইট এয়ানএক্সবেটিং করে হারিয়েছে।
বাপ্পি পড়ালেখা করেছেন এইচএসসি পর্যন্ত। পারিবারিক অভাব অনটনের জন্য ঢাকাতে এসেছিলেন গার্মেন্টসে চাকরি করার জন্য। ভর্তি হয়েছিলেন বিজেএমই'র ট্রেনিং প্রতিষ্ঠানে কিউসি ম্যানেজমেন্টে। তবে শারিরীক অসুস্থতার জন্য কোর্সটা সম্পন্ন করতে পারেননি তিনি। চলে যান গ্রামের বাড়ি শেরপুর। তবে চলে গেলেও সঙ্গে করে নিয়ে যান বায়িং হাউজ সম্পর্কে অর্জন করা জ্ঞান।
এসআই অজয় দাস বলেন, এই চক্রের মাধ্যমে অনেক চাকরি প্রত্যাশী পথে বসেছেন। আর তারা এমন ভাবে প্রতারণা করতেন কোনো ভাবেই তাদের খোঁজ পেতেন না ভুক্তভোগীরা। তিনি ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে নেওয়া প্রতারণার টাকা জুয়া সাইটের মাধ্যমে নিতেন। পরে সেই টাকা দিয়ে জুয়া খেলতেন। পরে জুয়া জিতে সেই টাকা নিজের অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করতেন।
- বিষয় :
- জুয়া