- অপরাধ
- গৃহবধূ হত্যা মামলার প্রধান আসামি 'নির্দোষ'
গৃহবধূ হত্যা মামলার প্রধান আসামি 'নির্দোষ'
গরু চুরি ঠেকাতে পিকআপের সামনে দাঁড়ানো নারীকে চাপা

আমিরুল ইসলাম
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার পঞ্চ সারটিয়াচর গ্রামে মঙ্গলবার রাতটি ছিল ভীতি-জাগানিয়া। ওই রাতে চোরের দল হানা দেয় কৃষক আমির চানের গোয়ালে। গরু চুরি করে পিকআপে তুলে পালানোর চেষ্টা করা হয়। এ সময় নিজের গোয়ালের গরু বাঁচাতে প্রাণ দেন আমির চানের স্ত্রী সেলিনা খাতুন। চোরচক্রের পিকআপে পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। এ ঘটনায় তাঁর ছেলে মো. জুবাইলও গুরুতর আহত হন।
গৃহবধূ নিহত হওয়ার ঘটনায় বুধবার তাঁর স্বামী আমির চান বাদী হয়ে সিরাজগঞ্জ সদর থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে কৃষক আমিরুল ইসলামকে। তিনি মামলার বাদী আমির চানের প্রতিবেশী। এজাহারে আমির চান দাবি করেন, ঘটনার রাতে চোরের দলের পিকআপে ছিলেন আমিরুল। তিনি 'গুলি কর, গুলি কর' বলে ভয় দেখিয়েছেন। এক পর্যায়ে আমিরুল ও তাঁর এক সহযোগী আমির চানকে ধাক্কা দিয়েছেন। এর পরই তাঁরা পিকআপভর্তি গরু নিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। তখন তাঁর স্ত্রী ও সন্তান পিকআপের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ালে ইচ্ছা করেই তাঁদের ধাক্কা দেওয়া হয়। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান তাঁর স্ত্রী সেলিনা।
চোরচক্রের পিকআপের ধাক্কায় গৃহবধূ নিহত হওয়ার ঘটনাটি চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনায় সিরাজগঞ্জ জেলা পুলিশ ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর একাধিক সংস্থা ঢাকা থেকে এর ছায়া তদন্ত শুরু করে। স্বাভাবিক কারণে হত্যা মামলার একমাত্র আসামি আমিরুলের সংশ্নিষ্টতা নিরূপণ ও তাঁর সহযোগীদের শনাক্তের চেষ্টা করে তারা। তদন্তে বেরিয়ে আসে- মামলার প্রধান আসামি আমিরুল চুরির ঘটনায় আদৌ জড়িত ছিলেন না। কারা, কীভাবে এ চুরির সঙ্গে জড়িয়েছিল- এটা প্রযুক্তিগত তদন্তে পুলিশ বের করেছে। নাটোর ও আশুলিয়ার একটি গ্রুপ এ ঘটনায় জড়িত। চুরির ঘটনায় সারটিয়াচর গ্রামের কারও সংশ্নিষ্টতা এখনও মেলেনি। আশুলিয়া থেকে গিয়ে গ্রুপটি সিরাজগঞ্জে চুরি করেছিল। তবে এরই মধ্যে সিরাজগঞ্জ জেলা পুলিশ মামলার আসামি আমিরুলকে গ্রেপ্তার করে দুই দিনের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিরাজগঞ্জ সদর থানার ওসি হুমায়ুন কবির সমকালকে বলেন, মামলায় যাকে আসামি করা হয়েছে, তার সংশ্নিষ্টতা পাওয়া যাচ্ছে না। ঘটনায় অন্য একটি গ্রুপ জড়িত- এমন কিছু তথ্য-উপাত্ত তাঁরা পেয়েছেন।
জড়িত না থাকা সত্ত্বেও কেন হত্যা মামলায় কৃষক আমিরুলকে আসামি করা হলো- এমন প্রশ্নে ওসি বলেন, একজনের স্ত্রী মারা গেছেন। সন্তান গুরুতর আহত। মামলা করার সময় তাঁর দেওয়া তথ্যমতো আসামি করা না হলে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে বাদী প্রশ্ন তুলতেন। এমন ক্ষেত্রে বাদীকে বেশি জেরাও করা যায় না। তিনি বলেন, এখন তাঁরা ভিন্ন তথ্য পাচ্ছেন। যাদের সংশ্নিষ্টতা পাচ্ছেন, তাদের গ্রেপ্তার করতে পারলেই আমিরুলকে ছাড়িয়ে আনার উদ্যোগ নেবেন। তাঁর প্রতি আর কোনো অবিচার হতে দেওয়া হবে না।
মামলাটির তদন্ত করছেন উপপরিদর্শক ইব্রাহিম। তিনি সমকালকে বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে আমিরুল দোষী- এর সপক্ষে কোনো জোরালো তথ্য নেই। দু'দিনের হেফাজতে এনে নানাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। তিনি বারবার নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মজিবুর রহমান বলেন, আমিরুলের মা ও স্ত্রী শুক্রবার তাঁর কাছে এসেছিলেন। নিরপরাধ একটি লোক প্রমাণ ছাড়া হত্যা মামলায় জেলে- এটা পরিবারের জন্য বেদনার। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে তিনি চেয়ারম্যানের কাছে তাঁদের পাঠিয়েছেন। একজন আইনজীবীর নম্বর দিয়ে সহযোগিতা নিতে বলেছেন। যাচাই ছাড়া কেন আমিরুলকে আসামি করা হলো- এটা পুলিশ বলতে পারবে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান ডিআইজি হারুন অর রশিদ বলেন, সিরাজগঞ্জের ঘটনাটি মর্মান্তিক। তাঁরা ছায়াতদন্ত করছেন। জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তারে একাধিক টিম ঢাকার বাইরে পাঠানো হয়েছে। ছায়াতদন্তের সঙ্গে যুক্ত অপর এক কর্মকর্তা জানান, গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব বা বিরোধের শিকার হতে পারেন আমিরুল। গৃহবধূর মৃত্যুর ঘটনাটি যেমন মর্মান্তিক, একইভাবে নিরপরাধ আমিরুলের কারাভোগ বেদনাদায়ক।
সয়দাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সবিদুল ইসলাম বলেন, আমিরুলের মা তাঁর কাছে গিয়েছিলেন। প্রশাসন তদন্ত করে প্রকৃত ঘটনা বের করবে। নির্দোষ হলে ছাড়া পাবেন- এটা তাঁকে তিনি বলেছেন। চুরির ঘটনায় যাঁর কথা বলা হচ্ছে, তিনি একটু পাগল টাইপের লোক বলে তিনি শুনেছেন।
এ ব্যাপারে মামলার বাদী আমির চানের সঙ্গে দু'দিন ধরে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। একাধিক দফায় ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
পুলিশ ও নিহত সেলিনার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মঙ্গলবার রাত ৩টার দিকে পঞ্চ সারটিয়াচর গ্রামে আমির চাঁনের বাড়িতে গরু চুরি করতে যায় চোরের দল। গোয়াল থেকে গরুর দড়ি খুলে পিকআপভ্যানে তোলার পর বিষয়টি টের পান সেলিনা খাতুন। চোররা পিকআপ নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় সেলিনা ও ছেলে জুবায়ের পিকআপের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে 'চোর, চোর' বলে চিৎকার করতে থাকেন। এ সময় চোরের দল মা-ছেলেকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
মন্তব্য করুন