প্রাণচঞ্চল শিশু নাদিয়ার বয়স মাত্র ১০ বছর। তার হেসেখেলে বেড়ানোর কথা; যাওয়ার কথা স্কুলে। কিন্তু অভাবের তাড়নায় তাকে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে পাঠিয়েছিলেন মা-বাবা। এতে সে তিন বেলা পেটপুরে খেতে পারবে– এটাই ছিল তাদের আশা। সেই সঙ্গে কিছু টাকাও পাবে। ওই টাকায় পরিবারের অন্য সদস্যদের দিনাতিপাত একটু হলেও সহজ হবে। তবে সেই আশায় গুড়ে বালি। ঠিকঠাক খাবার জুটত না হতভাগ্য মেয়েটির। উল্টো পান থেকে চুন খসলেই জুটত বেধড়ক পিটুনি। শেষ পর্যন্ত প্রাণটাই গেল তার। মৃত্যুর দু’দিন পর সোমবার রাতে রাজধানীর ইস্কাটনে লাশবাহী ফ্রিজিং ভ্যানে তার মৃতদেহ খুঁজে পায় পুলিশ।

রাজধানীর শাহজাহানপুরের শান্তিবাগ এলাকার ৮৭/১ নম্বর ভবন শান্তি নিকেতনের ২/সি নম্বর ফ্ল্যাটে দেড় বছর ধরে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে আসছিল নাদিয়া। ওই ফ্ল্যাটে থাকেন শ্রীলঙ্কার নাগরিক ফরহাদ বাঁধন মৌ। স্বজনের অভিযোগ, গৃহকর্ত্রীর নির্মম নির্যাতনে শিশুটির মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় মেয়েটির বাবা নাজিম উদ্দিন বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেছেন।

শাহজাহানপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ঠাকুর দাস মালো সমকালকে বলেন, অভিযুক্ত গৃহকর্ত্রী মৌকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এক দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তবে তিনি ঘটনার ব্যাপারে কিছুতেই মুখ খুলতে চাইছেন না। কীভাবে শিশুটির মৃত্যু হয়, তা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেলে নিশ্চিত হওয়া যাবে।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, শ্রীলঙ্কার নাগরিক এআর মালহোত্রার মেয়ে মৌ ১৯৮৪ সালে এ দেশে আসেন। কক্সবাজারের চকরিয়ার চিকিৎসক ফরহাদ বাঁধনের সঙ্গে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক ছিল। এক পর্যায়ে তাঁরা বিয়ে করেন। ঢাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেন তাঁরা। ওই চিকিৎসক কয়েক বছর আগে মারা যান। এখন শান্তিবাগের বাসায় মৌ একাই থাকেন। তাঁর বাসায় পাঁচ বছর ধরে কাজ করে আসছিল শিশু নাজমা। দেড় বছর আগে ছোট বোন নাদিয়াও তার সঙ্গে যোগ দেয়।

মৃতের মামা মো. একরামুল জানান, নাদিয়ার বাবা নাজিম উদ্দিন পঞ্চগড়ের আটোয়ারীতে কৃষিকাজ করেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে মৌ তাঁকে ফোন করে বলেন, নাদিয়া অসুস্থ। খবর পেয়ে তিনি সেদিন রাত ১টার দিকে এসে পৌঁছান। তখন তাঁকে বলা হয়, মেয়েটি মারা গেছে। কিন্তু মৃতদেহ দেখানো হয়নি। মৃতদেহ কোথায়, তাও বলতে রাজি হননি। বরং কিছু টাকা নিয়ে লাশ দাফন করার প্রস্তাব দেন তিনি। নাজিম এতে রাজি হননি। এক পর্যায়ে মৌ বাসায় তালা দিয়ে পালিয়ে যান। পরে ২৭ ফেব্রুয়ারি সকালে মেয়েটির বাবা জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে কল করে পুলিশি সহায়তা চান।

শাহজাহানপুর থানার এসআই সোহেলী আক্তার মৃতদেহের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করেন। তিনি উল্লেখ করেন, মেয়েটির মাথায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষতচিহ্ন, কপালের ডানে কাটা দাগ, বাম কানের পেছনে কালো কাটা দাগ, ডান গালে কালো-লালচে থেঁতলানো ও ফোলা জখম, নাক-মুখ দিয়ে লালা ও রক্ত বেরিয়ে এসেছে। বুক-পেটের বিভিন্ন অংশে লালচে-কালো দাগ; শরীরের বিভিন্ন অংশের চামড়া উঠে এসেছে; ডান হাতের কবজির নিচে লালচে-কালো দাগ; ডান হাঁটুতে থেঁতলানো জখম; ডান ঊরুতে পুরোনো কাটা দাগ রয়েছে।

এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, মেয়েটি নির্যাতনের শিকার হয়েছে– এটা নিশ্চিত। মৃতদেহের দাগগুলোই এর প্রমাণ। মেয়েটি রোগে ভুগছিল বলেও মনে হয়েছে। ঠিকমতো খেতে না পাওয়া ও নির্যাতনের কারণে তার মৃত্যু হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে মেয়েটিকে যখন স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হয়, তার আগেই সে মারা যায়।