পোষা পাখিকে মাঝেমধ্যে গোসল করাতে হয়; বিশেষত গরমের দিনে। আমার প্রাথমিক-পড়ুয়া পুত্রের দুই পোষা বাজরিগার অবশ্য পানাহারে যতটা আগ্রহী; স্নানে ততটা নয়। স্প্রে করতে গেলে দূরে সরে যায়। পহেলা বৈশাখের ছুটির অলস দিনে নিজের শরীরে গরম ও ঘামের প্রকোপ দেখে ভাবলাম, পাখি দুটিরও নিশ্চয় অস্বস্তি হচ্ছে। স্প্রে করতে গেলে এদিন যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল। স্প্রের মুখ যেদিকে ঘোরে, সেদিকেই গিয়ে হাজির হয়। আহা গরম, সবলা মানুষ ও অবলা পাখির দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়েছে!

এ পরিস্থিতি কম-বেশি বৃষ্টিহীন চৈত্র মাস থেকেই। আর বৈশাখের শুরু থেকেই চলছে তীব্র তাপদাহ। কেবল বাংলাদেশ নয়; প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা, মহারাষ্ট্র থেকে রাজস্থান পর্যন্ত অদৃশ্য আগুনে পুড়ছে। গত দু’দিন ধরে এই অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। চলতি তাপমাত্রার তীব্রতা সেলসিয়াস বা ফারেনহাইটে যদি বোঝা কঠিন হয়, তাহলে মরুর দেশ সৌদি আরবের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। পহেলা বৈশাখেও সেখানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তার মানে, বাংলাদেশের তাপমাত্রা এখন আক্ষরিক অর্থেই সৌদি আরবের চেয়ে বেশি।

তাপমাত্রার সঙ্গে ‘ফিল লাইক’ হিসাবও করতে হবে। সৌদি আরবে বাতাসের আর্দ্রতা বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম বলে আবহাওয়া গুমট হয়ে ওঠে না। সেখানে ৩৩ মানে ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসই অনুভূত হবে। আর আমাদের এখানে প্রকৃত তাপমাত্রাই যেখানে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস; সেখানে বোঝার ওপর শাকের আঁটি হিসেবে যোগ হয় ‘ফিল লাইক’ ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ গরম অনুভূত হবে আরও ৪-৫ ডিগ্রি বেশি। বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে– সৌদি আরবের গরম কেবল জ্বলন্ত উনুনের তাপ; আর বাংলাদেশে সেটা জ্বলন্ত উনুনের ওপর বসানো পানিভর্তি পাতিলের টগবগ সহযোগে।

আবহাওয়ার এই পরিস্থিতির প্রভাব কেবল মানুষ ও পশুপাখির অস্বস্তিতেই সীমিত নেই, বলা বাহুল্য। কৃষি, যোগাযোগ, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য– সর্বক্ষেত্রেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। রোববার সমকালের প্রতিবেদনের ভাষ্য– ‘তাপদাহে যশোরে গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন। তীব্র গরমে রেললাইন বেঁকে গিয়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কায় সতর্কতার সঙ্গে চলছে ট্রেন। ঝলসে যাচ্ছে ক্ষেতের ফসল। রোদে শুকিয়ে ঝরে যাচ্ছে আম-লিচু। দিনমজুর, রিকশাচালকরা রোজগারের তাগিদে পথে নামলেও ভয়ংকর রোদে কাহিল হয়ে পড়ছেন। হাসপাতালে বেড়েছে রোগী। (সমকাল, ১৬ এপ্রিল ২০২৩)।

প্রশ্ন হচ্ছে, এমন মরু-প্রমাণ তাপমাত্রা কী নদীমাতৃক বাংলাদেশের জন্য ভবিতব্য ছিল? চৈত্র মাসে বৃষ্টিহীনতা ও মাঠ-পুকুর শুকিয়ে চৌচির হওয়া নতুন নয়। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসের ভ্যাপসা গরমে মানুষ ও প্রকৃতির হাঁসফাঁস আদিকাল থেকেই দেখে আসছে এ অঞ্চল। কিন্তু এতটা গরম কবে পড়েছে? আবহাওয়াবিদরা বলছেন, রাজধানীতে এবারের গরম ৫৮ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। ঢাকার তাপমাত্রা সর্বশেষ ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠেছিল ১৯৬৫ সালের এপ্রিল মাসে। স্বীকার করতে হবে, কোনো কোনো দিন বা  সপ্তাহের তাপমাত্রার রেকর্ডভঙ্গ নিছক আবহাওয়াজনিত বিশেষ পরিস্থিতি। যেমন এ বছর টানা বৃষ্টিহীনতা ও তাপমাত্রা বেড়ে চলছে, কারণ বঙ্গোপসাগর থেকে পর্যাপ্ত মেঘ তৈরি হচ্ছে না। ফলে আকাশে ভেসে বেড়ানো আচ্ছাদন ও বাতাসে জলীয় বাষ্প কমে গিয়ে তাপমাত্রা অসহনীয় করে তুলছে। কিন্তু সেই ভ্যাপসা গরম অসহনীয় উঠবে কেন?

খোদ মরুর দেশে প্রাকৃতিকভাবেই কিছু সুশীতল এলাকা থাকে, যেগুলোকে মরূদ্যান বলা হয়। বিশেষ কিছুই নয়; কিছু গাছপালা ও চিলতেখানিক পানির উৎস। তাতেই পরাভূত হয় তীব্র গরম ও তপ্ত হাওয়া। মরুভূমির দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা সমগ্র বাংলাদেশই ছিল মরূদ্যান। আবহাওয়ার বিশেষ পরিস্থিতিতে তাপমাত্রা ডিগ্রি, সেলসিয়াস বা ফারেনহাইটে রেকর্ডভঙ্গ করলেও বৃহৎ বঙ্গে তার প্রভাব কখনও এভাবে মানুষ ও প্রকৃতির জন্য বিরূপ হয়ে ওঠেনি। এটা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই– ১৯৬৫ সালের এপ্রিলে ঢাকার তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রিতে উঠলেও এভাবে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠেনি। কারণ তখনও পূর্ববঙ্গের এই প্রধান শহর ছিল সজল ও শ্যামল।

সম্প্রতি আমি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সার্ভেয়ার জেমস রেনেলের একটি দুষ্প্রাপ্য জার্নাল ভাষান্তরে হাত দিয়েছি। তাতে ২৬০ বছর আগে প্রায় তিন বছর ধরে ঢাকা ও পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিদিনের আবহাওয়া পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে তিনি ১৭৬৫ সালের এপ্রিল মাসের আবহাওয়া পরিস্থিতি সম্পর্কে লিখেছেন এভাবে– ‘এপ্রিল মাস শুরু হলো চমৎকার আবহাওয়া দিয়ে। ৭ তারিখ পর্যন্ত সাধারণভাবে পশ্চিম থেকেই মোটামুটি শীতল বাতাস বইছিল। বিশেষত ৬ তারিখের বায়ুপ্রবাহ ছিল শরীরজুড়ানো।’

কৌতূহলবশত দেখতে চেয়েছিলাম, এই নিবন্ধ যেদিন লিখছি, সেই ৩ বৈশাখ ঢাকার আবহওয়া কেমন ছিল। জেমস রেনেল লিখেছেন– ‘১৬ এপ্রিল সারাদিন আবহাওয়া শীতল, রাতে ঝোড়ো হাওয়া, সকালের দিকে সামান্য বৃষ্টিপাত।’ আহা, আজও যদি এমন আবহাওয়া থাকত! থাকতেও পারত।

জেমস রেনেলের সময় এমন আবহাওয়া সম্ভব ছিল। কারণ চারপাশের বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ছাড়াও বর্তমান ঢাকা শহরের ভেতরেই প্রবাহিত ছিল অন্তত চারটি নদী– নড়াই, দোলাই, পাণ্ডু, সোনাভান। জালের মতো ছড়িয়ে ছিল শতাধিক খাল। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল বিল-ঝিল ও জলাশয়। ঢাকা ওয়াসা যেহেতু তখনও দূষিত পানির কারবার জমাতে পারেনি; বাড়ি বাড়ি ছিল পুকুর; পান ও স্নানের জন্য। সেই সুজলা-সুফলা ঢাকা আমরা হারিয়ে ফেললাম কীভাবে? বিভিন্ন গবেষণায় এটা প্রামাণিত– শুরুটা হয়েছিল এই মুঘল শহরের আবাসিক ও বাণিজ্যিক ‘উন্নয়ন’ করতে গিয়ে। বুড়িগঙ্গা তীরের ‘পুরান ঢাকা’ ক্রমেই আড়ে ও বহরে সম্প্রসারিত হয়েছে এবং সবুজ উধাও। জলাভূমি ভরাট হয়েছে। ভূমির পুকুর হারিয়ে ছাদের চৌবাচ্চা এসেছে। ইটের পর ইট মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে; সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে তাপমাত্রা।

মাত্রাগত ভিন্নতা থাকলেও এখন একই পরিস্থিতি রাজধানীর বাইরের শহরগুলোতেও। এক সময় ছায়াঘেরা জেলা বা বিভাগীয় শহরগুলো ক্রমেই ঢাকার পদাঙ্ক অনুসরণ করে সবুজ বিদায় করে কংক্রিটের বিবর্ণ জঙ্গলে পরিণত হচ্ছে। দখল ও দূষণ হচ্ছে নদী। গ্রামাঞ্চলেও এখন পুকুর ও জলাশয় যেন বড় বালাই। ভরাট করে আবাসিক ও বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণেই মোক্ষ। তাই তাপমাত্রার ক্ষেত্রে এখন আর ঢাকা কিংবা গ্রামাঞ্চলের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য করা যায় না।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অস্বীকার করা যাবে না। বৈশ্বিকভাবেই নির্বিচার কার্বন উদ্গীরণের কারণে আমাদের এই নীল গ্রহের তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়ছে এবং সেখানে দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবদান সামান্যই। কিন্তু ঢাকার নদী, জলাশয়, পুকুর কি কার্বন উদ্গীরণের কারণে ভরাট হয়েছে? ঢাকার গাছপালা, উদ্যান, খোলা মাঠ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নিশ্চিহ্ন হয়েছে? এই যুক্তি দিলে ‘হালায় ঘোড়ায় ভি হাছবো’।

নির্বিচারে নদী-মারা এই দেশে মরুর তাপমাত্রা ছাড়া আর কী ভবিতব্য থাকতে পারে?

শেখ রোকন: সহযোগী সম্পাদক, সমকাল; মহাসচিব, রিভারাইন পিপল
skrokon@gmail.com