দেড় বছরের ফুটফুটে শিশু জারা আক্তার সুরার মরদেহ পাওয়া যায় বাসার বাথরুমের বালতিতে। তখন মা মৌসুমী আক্তার জানান, রাতের কোনো এক সময় বালতির পানিতে ডুবে জারার মৃত্যু হয়। এর পর ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করা হয় মরদেহ। সন্দেহ হওয়ায় পর কবর থেকে মরদেহ তুলে ময়নাতদন্ত করা হয়। তাতেও মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কিন্তু সময় যতই গড়াতে থাকে, ততই সামনে আসে নতুন তথ্য। এক পর্যায়ে তদন্তে বেরিয়ে আসে শিশুটিকে শ্বাসরোধে হত্যা করেছেন মা ও তাঁর প্রেমিক। তিন বছর আগে রাজধানীর কদমতলীর এ ঘটনায় সম্প্রতি অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

পিবিআই ঢাকা মহানগর দক্ষিণের এসআই আকরাম হোসেন সমকালকে বলেন, শিশুটির বাবার বন্ধু জামাল হোসেনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে মৌসুমীর। এক রাতে তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তে জারা কান্নাকাটি করছিল। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বালিশচাপা দিয়ে তাকে হত্যা করেন জামাল। এ সময় সন্তানের পা চেপে ধরে তাঁকে সহায়তা করেন মৌসুমী। ওই নারীর অপর দুই সন্তান পরে আদালতে জবানবন্দিতে সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে। এর আগে হত্যার হুমকি দেওয়ায় ভয়ে তারা মুখ খোলেনি।

এদিকে পিবিআইর আগে মামলাটি তদন্ত করে কদমতলী থানা পুলিশ। তবে তারা তদন্তে গড়িমসি করছিল বলে অভিযোগ বাদীর। সুষ্ঠু তদন্তের বদলে সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা আসামি পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে মামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন বলেও সন্দেহ ছিল তাঁর। পরে তাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কর্মকর্তা বদল করা হয়। এর পরও তদন্তে গতি না আসায় মামলাটি পিবিআইয়ে স্থানান্তরের আবেদন জানান তিনি।

পিবিআই সূত্র জানায়, কদমতলীর পূর্ব জুরাইনের কমিশনার রোডের তারকাঁটা ফ্যাক্টরি এলাকার বাসায় পরিবারের সঙ্গে থাকত ১ বছর ৭ মাস বয়সী জারা। তার বাবা আলী হোসেন সৌদি আরবপ্রবাসী। ২০১৮ সালে বিদেশে যাওয়ার আগে জামালের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। এর সুবাদে সন্তানসম্ভবা স্ত্রী (জারা তখন মাতৃগর্ভে) ও দুই সন্তানকে দেখভালের জন্য বন্ধুকে অনুরোধ করেন আলী হোসেন। ফলে সময়-অসময়ে নিয়মিত ওই বাসায় যেতেন জামাল। এক পর্যায়ে মৌসুমীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর মধ্যে জারা ভূমিষ্ঠ হয় ও বেড়ে উঠতে থাকে। সেই সঙ্গে এগোতে থাকে জামাল-মৌসুমীর সম্পর্ক।

২০২০ সালের ১৩ জুলাই রাত ১১টার দিকে তিন সন্তানকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেন মৌসুমী। এর পর তিনি জামালের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন। এক পর্যায়ে জারা কেঁদে উঠলে তারা বিরক্ত ও ক্ষিপ্ত হন। শিশুটিকে তাদের সম্পর্কের পথে ‘ঝামেলা’ আখ্যা দিয়ে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন। জারাকে হত্যার পর বাথরুমের বালতিতে চুবিয়ে রেখে পালিয়ে যান জামাল। মৌসুমীর ছেলে রাতুল (তখন ১১ বছর) ও মেয়ে সারা (তখন ৯ বছর) পুরো ঘটনাটি দেখে। বিষয়টি বুঝতে পেরে তাদের চুপ থাকতে বলেন মৌসুমী। চুপ না থাকলে তাদেরও হত্যার হুমকি দেন। পরে ভোরে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে মৌসুমী বলতে থাকেন, জারা কোথায়? চিৎকার শুনে শিশুটির দাদা ও ফুপু সেখানে যান এবং বাথরুমে বালতির ভেতর মরদেহ পান।

জারার চাচা ও মামলার বাদী নূর হোসেন বলেন, সন্তানের মরদেহ কাটা-ছেঁড়া করতে দেবেন না বলে প্রচুর কান্নাকাটি করেছিলেন মৌসুমী। এ কারণে ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করা হয়। জুরাইনের বাসায় থাকলে জারাকে মনে পড়ে, এই বলে তিনি দুই সপ্তাহের মাথায় বংশালে অন্য বাসায় ওঠেন। তবে ঘটনার মাসখানেক পর রাতুল ও সারা প্রকৃত ঘটনা স্বজনদের জানায়। তখন হত্যা মামলা করা হয়।
আলী হোসেন সৌদি আরব থেকে মোবাইল ফোনে সমকালকে বলেন, আর কোনো বাবাকে যেন এমন পরিস্থিতির শিকার না হতে হয়। আমি দায়ীদের কঠোর শাস্তি চাই। পুলিশ জানায়, জামাল এখন কারাগারে এবং মৌসুমী জামিনে রয়েছেন।