- ঢাকা
- আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে প্রশাসনের ‘উস্কানি’
নরসিংদী বিএনপিতে গৃহদাহ
আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে প্রশাসনের ‘উস্কানি’

নরসিংদী জেলা বিএনপি গৃহদাহের উত্তাপ কমছেই না। দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও জেলার আহ্বায়ক খায়রুল কবীর খোকন বলয়কে কোণঠাসায় তৎপর রয়েছেন কয়েকজন স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা। জেলা বিএনপির সদস্য সচিব মঞ্জুর এলাহী ছাড়াও যুগ্ম আহ্বায়ক হারুন অর রশীদ, জেলা যুবদলের সভাপতি মহসিন হোসেন বিদ্যুৎ প্রকাশ্যে খোকনবিরোধীদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এতে জেলা ছাত্রদলের কমিটিকে কেন্দ্র করে দু’জনের মৃত্যুর পরও হামলা, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছেই। আবার এসব সহিংসতার পেছনে যেমন দলের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের ইস্যু রয়েছে, তেমনি স্থানীয় প্রশাসনের ‘উস্কানি’ও রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন দলটির নেতাকর্মীরা। অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে প্রশাসন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি গঠন থেকেই কমিটির আহ্বায়ক খায়রুল কবীর খোকন ও সদস্য সচিব মঞ্জুর এলাহীর মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। এর ফলে জেলায় আধিপত্য বিস্তারে একে অপরকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করতে থাকেন তাঁরা। খোকন বলয়ের বাইরের অংশটিকে মঞ্জুর এলাহী মদদ দিতে থাকেন। অন্যদিকে, খোকনও নিজের বলয় শক্তিশালী করতে তৎপর হয়ে ওঠেন। তবে জেলার এ কোন্দল নিরসন করতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে দায়িত্ব দেন দলের হাইকমান্ড। সম্প্রতি তিনি এ দুই নেতাকে নিয়ে বৈঠক করে তাঁদের কোন্দল নিরসন করে মিলিয়ে দেন।
অবশ্য দীর্ঘ ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে নরসিংদীর নেতৃত্ব দেওয়া খায়রুল কবীর খোকনকে নিয়ে জেলায় অসন্তোষ রয়ে গেছে। তাই তাঁকে বাদ দিয়ে নতুন কমিটি গঠনে একটি পক্ষ সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা জেলা কমিটি ভেঙে নিজেদের পছন্দমতো কমিটি গঠনে বহুদিন ধরে চেষ্টা করছে। আরেকটি পক্ষ খোকনকে শুধু কমিটি থেকেই মাইনাস নয়, তাঁর সংসদীয় আসন থেকেও কৌশলে সরিয়ে দিতে চাচ্ছে। আবার খোকনও নিজের আধিপত্য ধরে রাখার জন্য জেলার সবকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সব কমিটিতে প্রভাব বিস্তারে তৎপর ছিলেন। প্রতিটি পক্ষই নিজ নিজ এজেন্ডা নিয়ে থাকলেও প্রকাশ্যে কোনো কোন্দল সৃষ্টি হয়নি। তবে জেলা ছাত্রদলের কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে বিদ্যমান অসন্তোষকে সব পক্ষই কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। খায়রুল কবীর খোকনের একচেটিয়া কমিটি বাগিয়ে নেওয়ার ঘটনায় তা চরম আকার ধারণ করে।
স্থানীয় নেতাদের মতে, ঘটনার শুরুতে জেলা বিএনপির সদস্য সচিব মঞ্জুর এলাহী পদবঞ্চিত আর বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখেন। দলের হাইকমান্ডের নির্দেশের পর তিনি সেখান থেকে কিছুটা সরে এসে কৌশলী হয়ে চলছেন। এখন নতুন করে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাবেক এমপি সামসুদ্দিন এছাকের ছেলে হারুন অর রশীদ, জেলা যুবদলের সভাপতি মহসিন হোসেন বিদ্যুৎ (বর্তমানে কারাগারে) বিক্ষুব্ধদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন। এর মধ্যে মহসিন হোসেন বিদ্যুৎ জেলার বিএনপির আহ্বায়ক খোকন ও বিদ্রোহী উভয় দিকে থাকতেন। দু’পক্ষকেই তিনি উস্কে দিতেন। যদিও শেষ রক্ষা হয়নি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিহত ছাত্রনেতাকে দেখতে এসে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন তিনি।
অন্যদিকে হারুন অর রশীদ মনে করছেন, নরসিংদী সদরে বিএনপিকে শক্তিশালী করেছেন তাঁর প্রয়াত বাবা। তিনি চারবারের সাবেক এমপি ছিলেন। আগামীতে এই আসনের মূল দাবিদার তিনি। এজন্য খোকনকে দুর্বল করতে পারলে তাঁর নেতৃত্বাধীন জেলা বিএনপির কমিটি ভেঙে দিতে পারলে এই আসনে তাঁর মনোনয়ন অনেকটা সহজ হবে। গত বুধবার খোকনের বাড়িতে অগ্নিসংযোগের পর ছাত্রদলের বিদ্রোহীরা হারুন অর রশীদের বাড়িতে বৈঠক করেন বলেও জেলার অনেক নেতা অভিযোগ করেন।
২৬ জানুয়ারি জেলা ছাত্রদলের ৫ সদস্যের আংশিক কমিটির অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রদল। ওই কমিটিতে সিদ্দিকুর রহমানকে সভাপতি, মাইন উদ্দিন ভূঁইয়াকে সিনিয়র সহসভাপতি ও মেহেদী হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। ওই দিনই জেলা বিএনপির কার্যালয়ের প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে শতাধিক প্লাস্টিকের চেয়ার, ব্যানার, প্রচারপত্র ও ফেস্টুনে আগুন লাগিয়ে দেন পদবঞ্চিতরা। পরে পর্যায়ক্রমে খোকনের কুশপুত্তলিকা দাহ, খোকনের গাড়িবহরে গুলি ও ককটেল হামলা এবং একাধিকবার খোকনের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ককটেল হামলার ঘটনা ঘটে।
গত ২৫ মে বিকেলে ঘোষিত কমিটি বাতিলের দাবিতে শতাধিক পদবঞ্চিত ছাত্রদল নেতা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। এ সময় শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে জেলখানা মোড় হয়ে জেলা বিএনপির কার্যালয়ের সামনে যাওয়ার পথে প্রতিপক্ষ গ্রুপ তাঁদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায় এবং গুলিবর্ষণ করে। এতে জেলা ছাত্রদলের সাবেক নেতা সাদেকুর রহমান ও আশরাফুল ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, দিনের পর দিন পদবঞ্চিত গ্রুপটি শুধু খায়রুল কবীর খোকনের বাড়িতেই হামলা ও ভাঙচুরে সীমাবদ্ধ ছিল না। জেলখানা মোড় থেকে খায়রুল কবীর খোকনের বাড়ি পর্যন্ত বিভিন্ন বাড়িঘর ও দোকানপাটেও ভাঙচুর চালায়। এর ফলে এলাকার সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পুলিশসহ স্থানীয় প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করে। এ বিষয়টি নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
দলটির নেতাকর্মীর অভিযোগ, পুলিশ প্রশাসন পদবঞ্চিত এই গ্রুপটিকে প্রত্যক্ষভাবে মদদ দিয়ে গেছে। তাদের উস্কে দিয়ে ঘটনাকে রক্তাক্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দেখেও যেন না দেখার ভান তাদের। খায়রুল কবীর খোকনের বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় এখনও থানায় কোনো মামলা হয়নি।
এ বিষয়ে বিএনপি নেতা খায়রুল কবীর খোকনের সঙ্গে যোগাযোগ করা না গেলেও তাঁর স্ত্রী ও বিএনপির কেন্দ্রীয় স্বনির্ভরবিষয়ক সম্পাদক শিরিন সুলতানা সমকালকে বলেন, ছাত্রদলের কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে যতটা না সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, তার চেয়ে বেশি হয়েছে পুলিশ প্রশাসনের উস্কানি। জেলা পুলিশের প্রত্যক্ষ মদদে এবং তাদের নির্দেশনায় সংগঠনের কতিপয় নেতাকর্মী এ উশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। পুলিশের সামনেই তাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে, ককটেল মারা হয়েছে, ভাঙচুর করা হয়েছে, গুলি করা হয়েছে।
সাবেক এ মহিলা সংসদ সদস্য প্রশ্ন রেখে বলেন, যেখানে বিএনপি নেতাকর্মীরা কর্মসূচি পালনে রাস্তায় এক মিনিট অবস্থান করতে পারেন না, সেখানে পুলিশের উপস্থিতিতে কীভাবে একের পর এক নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়? রাষ্ট্রযন্ত্র এই সমস্যা সৃষ্টি করছে বিএনপিকে দুর্বল করার জন্য। ছাত্রদলের দুই নেতা নিহতের ঘটনার দিন খায়রুল কবীর খোকনসহ জেলা ছাত্রদলের সুপার ফাইভ কমিটি ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। তাহলে তাদের ওপর হামলা করল কারা?
অভিযোগ অস্বীকার করে নরসিংদী সদর থানার ওসি আবুল কাশেম ভূঁইয়া সমকালকে বলেন, খোকনের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ কিংবা অন্যান্য দোকনঘরে ভাঙচুরের কোনো অভিযোগ তাঁরা পাননি। কেউ অভিযোগ না করলে তাঁরা মামলা নিতে পারেন না। পুলিশের সামনে এসব ঘটনা ঘটার বিষয়ে জানতে চাইলে এড়িয়ে যান তিনি।
বহিষ্কৃত ছাত্রদল নেতা মাইন উদ্দিন ভূঁইয়া সমকালকে জানান, তিনি জেলা ছাত্রদলের কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশী ছিলেন। কিন্তু তাঁকে সিনিয়র সহসভাপতি করা হয়। বিগত আহ্বায়ক কমিটিতে তিনি সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু খায়রুল কবীর খোকন তাঁর অনুসারীদের দিয়েই কমিটি গঠন করেন। তখন থেকেই পদবঞ্চিত নেতাদের সঙ্গে নিয়ে এর প্রতিবাদ করি।
তবে জেলার অন্য ছাত্রদল নেতারা জানান, মাইন উদ্দিন ভূঁইয়া বিবাহিত। সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত আওয়ামী লীগ নেতা ও নরসিংদী পৌর মেয়র লোকমান হোসেন হত্যা মামলার প্রধান আসামি মোবারক হোসেন মোবার মেয়েকে সম্প্রতি বিয়ে করেছেন মাইন। এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের একাধিক অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। এর পরও বিভিন্ন তদবিরে তাঁকে সিনিয়র সহসভাপতি করা হয়। কিন্তু কমিটিতে স্থান পাওয়ার পরও সে বিদ্রোহ করে বলে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়।
মন্তব্য করুন