ঢাকা শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

তিন গুণ ভাড়া দিচ্ছে প্রিমিয়ার ব্যাংক

তিন গুণ ভাড়া দিচ্ছে প্রিমিয়ার ব্যাংক

ওবায়দুল্লাহ রনি

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১৭ মে ২০২২ | ২১:২৬

যেন আরব্য রজনির আলাদিনের চেরাগ। প্রদীপ ঘষা দিলেই দৈত্য বেরিয়ে এসে পূরণ করছে মনের ইচ্ছা। বাস্তবেও ইচ্ছা পূরণের এমন ঘটনা ঘটেছে। প্রিমিয়ার ব্যাংকের দুটি শাখায় তাদের কাছে ভবন মালিক যে ভাড়া চাইছেন, তা-ই মিলছে। প্রচলিত দর, আশপাশের ভবনের ভাড়ার হার কোনো কিছুই বিবেচ্য হয় না। মিলে যায় দ্বিগুণ-তিন গুণ দরে ভাড়ার টাকা।

বেসরকারি প্রিমিয়ার ব্যাংকের গুলশান ও বনানী শাখার কাছে ভবন ভাড়া দিয়ে বছরে ১২ কোটি ১২ লাখ টাকা আয় করছে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ডা. এইচ বি এম ইকবালের পরিবার। বছরে গুলশান শাখার ভাড়া প্রতি বর্গফুট ৮ হাজার ৫৬৮ টাকা, আর বনানী শাখার ৪ হাজার ৮২৪ টাকা। যদিও ওই এলাকায় প্রচলিত দর ১ হাজার ৪০০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা।

ব্যাংকটির গুলশান শাখা ৯ বছর ও বনানী শাখা ৬ বছরের চুক্তিতে ডা. ইকবালের মালিকানাধীন ভবনে ফ্লোর ভাড়া নিয়েছে। এ সময়ে শাখা দুটির ভাড়া বাবদ ব্যয় হবে ৯৮ কোটি ৯১ লাখ টাকা, যা ওই এলাকার প্রচলিত ভাড়ার চেয়ে তিন গুণ বেশি। অস্বাভাবিক এমন ভাড়ার তথ্য সমকালের অনুসন্ধানে মিলেছে।

প্রিমিয়ার ব্যাংকের গুলশান শাখার অবস্থান রাজধানীর ৭৮ গুলশান অ্যাভিনিউ। এটি মূলত ডা. ইকবালের মালিকানাধীন রেনেসাঁস হোটেল। গত ১৯ এপ্রিল সরেজমিনে দেখা যায়, হোটেলের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার দক্ষিণ পাশে গুলশান শাখার অবস্থান। দুই ফ্লোর মিলে আয়তন ১০ হাজার ২০০ বর্গফুট। প্রতি বর্গফুটের মাসিক ভাড়া ৭১৪ টাকা। প্রতিবছর যা দাঁড়ায় ৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। ২০১৬ সালের ৭ মার্চ থেকে ২০২৫ সালের ৬ মার্চ পর্যন্ত ৯ বছরের জন্য ভাড়ার চুক্তি রয়েছে। ফলে ৯ বছরে শুধু এর ভাড়া বাবদ ব্যাংকের ব্যয় হবে ৭৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এ সময়ে যে পরিমাণ জায়গায় এ ভাড়া দেওয়া হচ্ছে, বর্তমান বাজারদর হিসেবে তা দিয়ে একই এলাকায় প্রায় তিন গুণ ফ্লোর কেনা সম্ভব।

প্রিমিয়ার ব্যাংকের গুলশান শাখার উল্টো পাশে কয়েক গজ দূরত্বে মধুমতি ব্যাংকের গুলশান শাখার অবস্থান। মোট ৫ হাজার ৭০০ বর্গফুটের শাখায় প্রতি বর্গফুট ভাড়া ২৯৫ টাকা। এর মানে কয়েক গজের ব্যবধানে প্রিমিয়ার ব্যাংকের গুলশান শাখার ভাড়া অন্য ব্যাংকের চেয়ে আড়াই গুণ বেশি। গুলশান এলাকার আরও কয়েকটি ব্যাংক শাখার ফ্লোর ভাড়ার তথ্য সংগ্রহ করেছে সমকাল। কোথাও প্রিমিয়ার ব্যাংকের মতো এত বেশি ভাড়ার নজির পাওয়া যায়নি। এ শাখার ভাড়া দেশের সব শাখার মধ্যে বেশি।

প্রিমিয়ার ব্যাংকের বনানী শাখাও ডা. ইকবালের মালিকানাধীন ভবনে, যা বনানী এলাকায় সর্বোচ্চ ভাড়ার ব্যাংক শাখা। ৪২ কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউর ইকবাল সেন্টারে থাকা শাখাটি মাসে প্রতি বর্গফুটের জন্য ভাড়া দিচ্ছে ৪০২ টাকা। মোট সাত হাজার বর্গফুট জায়গা ২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ছয় বছরের জন্য ভাড়ার চুক্তি রয়েছে। এ শাখার ভাড়া বাবদ বছরে ব্যাংকটি ব্যয় করছে ৩ কোটি ৩৭ লাখ ৬৮ হাজার টাকা।

ছয় বছরে দিতে হবে ২০ কোটি ২৬ লাখ টাকা। প্রিমিয়ার ব্যাংকের বনানী শাখার উল্টো দিকে ব্যাংক এশিয়ার বনানী শাখার অবস্থান। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি বর্গফুট ১৪৫ টাকা ভাড়া দিচ্ছে ব্যাংক এশিয়া। কয়েক গজের ব্যবধানে প্রতি বর্গফুট ভাড়ায় প্রায় তিন গুণ ব্যবধান।
আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ ডা. এইচ বি এম ইকবাল পরিবারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে প্রিমিয়ার ব্যাংক। ডা. ইকবাল দীর্ঘদিন ধরে প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান। তাঁর এক ছেলে মঈন ইকবাল বর্তমানে ব্যাংকটির ভাইস চেয়ারম্যান এবং আরেক ছেলে মোহাম্মদ ইমরান ইকবাল পর্ষদের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান। তাঁর স্ত্রী মমতাজ ইকবালও ছিলেন ব্যাংকটির পরিচালক।

সার্বিক তথ্য উল্লেখ করে প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান ডা. এইচ বি এম ইকবালের কাছে জানতে চাইলে তিনি সমকালকে বলেন, অস্বাভাবিক ভাড়ার বিষয়ে প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান ডা. এইচ বি এম ইকবাল কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। গতকাল তাঁর মোবাইলে ফোন করা হলে প্রথমে তিনি ধরেননি। এসএমএস করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। পরে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপে সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করে বার্তা পাঠানো হয়। এরপর তিনি ফোন ধরেন। এ প্রতিবেদক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমি দেশের বাইরে আছি। এ বিষয়ে এ মুহূর্তে কোনো মন্তব্য করব না।' দু-এক মিনিটের জন্য সময় চাইলেও তিনি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, 'এক মাস পরে ফোন করেন।'

প্রিমিয়ার ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম রেজাউল করিমের মোবাইল ও হোয়াটসঅ্যাপে ফোন ও এসএমএস করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। পরে ব্যাংকের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান জাকারিয়া রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে এমডির বক্তব্য পাওয়ার চেষ্টার বিষয়টি জানানো হয়। এরপরও ব্যাংকের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি নিয়ে প্রশ্ন

বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি নিয়েই এমন অস্বাভাবিক ভাড়া দিচ্ছে প্রিমিয়ার ব্যাংক। জানা গেছে, ভবন ভাড়ার অনাপত্তির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানোর আগে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রিমিয়ার ব্যাংকের দুটি শাখার ভাড়া কেন অস্বাভাবিক মনে হয়নি- তা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম এ বিষয়ে সমকালকে বলেন, ভাড়ার নামে ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নেওয়া ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংক তথ্য যাচাই করে। প্রয়োজনে সরেজমিনে আশপাশের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কিনা দেখে অনুমোদন দেয়।
প্রিমিয়ার ব্যাংকের গুলশান ও বনানী শাখার ভাড়ার তথ্য উল্লেখ করে এর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, 'আশপাশে কেমন ভাড়া, তা জানা নেই।' অন্য কয়েকটি শাখার ভাড়ার তথ্য জানানোর পর তিনি বলেন, অস্বাভাবিক কিছু ঘটলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে চলে আসে। পরে ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগকে অবহিত করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, অস্বাভাবিক এ ভাড়া নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্নিষ্ট বিভাগ থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। শুরুতে বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও অনুমোদন না দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। তবে অদৃশ্য কারণে পরে আবার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ফাইল ছেড়ে দিতে বলেন। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মিত পরিদর্শনে অনেক বেশি ভাড়া এবং জায়গার বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। এর পরও এ নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

অন্য ব্যাংকের ভাড়া কেমন

দেশে সরকারি, বেসরকারি ও বিদেশি ৬১টি ব্যাংক রয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এসব ব্যাংকের মোট শাখার সংখ্যা ১০ হাজার ৯৪১টি। অধিকাংশ ব্যাংকের মোট আয়ের বড় অংশ আসে মতিঝিল, গুলশান ও বনানী শাখা থেকে। ব্যাংকগুলোর প্রধান কার্যালয়ও এসব এলাকায়। ফলে এসব এলাকায় ভাড়া ও সাজসজ্জা তুলনামূলক বেশি ব্যয় হয়। তাই বলে প্রিমিয়ার ব্যাংকের গুলশান ও বনানী শাখার মতো আশপাশের কোনো শাখায় এত ভাড়া নেই। ভালো লোকেশন ও নান্দনিক সাজসজ্জায় যেসব ব্যাংক পরিচালিত হয়, তার অন্যতম বেসরকারি খাতের ব্র্যাক ব্যাংক। ব্যাংকটির গুলশান শাখার প্রতি বর্গফুটের মাসিক ভাড়া ৩০৬ টাকা। সিটি ব্যাংকের গুলশান উইমেন শাখার ভাড়া বর্গফুট প্রতি ৩০০ টাকা। ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের গুলশান শাখার ভাড়া ২৯৪ টাকা। বিদেশি মালিকানার এইচএসবিসি ব্যাংকের গুলশান শাখা ৯ হাজার বর্গফুট আয়তনের। ব্যাংকটি প্রতি বর্গফুট ২৩৭ টাকা ভাড়া দিচ্ছে।

বনানীতেও সর্বোচ্চ

প্রিমিয়ার ব্যাংকের বনানী শাখা প্রতি বর্গফুট ৪০২ টাকা হারে ভাড়া দিলেও অন্য কোনো ব্যাংকে এত ভাড়ার তথ্য পাওয়া যায়নি। সমকালের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ব্র্যাক ব্যাংকের বনানী শাখা প্রতি বর্গফুট ২২১ টাকা ভাড়ায় চলছে। ব্র্যাক ব্যাংকের এ শাখা মোট ৭ হাজার ৮০০ বর্গফুট এলাকায়। সিটি ব্যাংকের বনানী শাখা প্রতি বর্গফুটের ভাড়া দিচ্ছে ২৬৫ টাকা। কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউতে মোট ১৩ হাজার ৫০০ বর্গফুটজুড়ে এর অবস্থান। শাহ্‌জালাল ইসলামী ব্যাংক বনানী শাখার জন্য ২১০ টাকা বর্গফুট হারে ভাড়া দিচ্ছে।

প্রকৃত ভাড়া অনেক কম

প্রিমিয়ার ব্যাংকের গুলশান শাখা যে রেনেসাঁস হোটেলে অবস্থিত, তার ঠিক উল্টো পাশে কনকর্ড সিলভি হাইটস নামে একটি নতুন ভবন হয়েছে। আধুনিক ভবনটিতে ফ্লোর ভাড়ার জন্য 'টু-লেট' টানানো হয়েছে। একটি কোম্পানির প্রতিনিধি পরিচয়ে যোগাযোগ করলে জানানো হয়, ভবনটির চতুর্থ তলার ৩ হাজার ২০০ বর্গফুট জায়গা ভাড়া দেওয়া হবে। প্রতি বর্গফুট ১৮০ টাকায় ভাড়া দেওয়া হবে। আলোচনার ভিত্তিতে কমানোরও সুযোগ রয়েছে।

ফ্ল্যাট ভাড়া এবং বেচাকেনার অনলাইন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে বিপ্রপার্টি ডটকম। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে গুলশান-বনানীর বিভিন্ন এলাকায় ভবন ভাড়ার বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। গুলশান আরএম সেন্টারে পাঁচ হাজার বর্গফুটের একটি ফ্লোর ৯ লাখ টাকায় ভাড়ার বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। এর মানে প্রতি বর্গফুটের মাসিক ভাড়া ১৮০ টাকা।

প্রিমিয়ার ব্যাংকের গুলশান শাখার পেছন দিকে ৬ হাজার ৫০ স্কয়ার ফুটের অন্য একটি ফ্লোর ৭ লাখ ২৬ হাজার টাকায় ভাড়ার বিজ্ঞাপন ঝুলছে। এতে প্রতি বর্গফুট ভাড়া দাঁড়ায় ১২০ টাকা। একইভাবে বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউর একটি বাণিজ্যিক ভবনে অফিস ভাড়ার জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। মোট ৫ হাজার ৬৭৪ বর্গফুটের মাসিক ভাড়া উল্লেখ করা হয়েছে ১১ লাখ টাকা। এর মানে বর্গফুট প্রতি ভাড়া দাঁড়ায় ১৯৪ টাকা।

আবাসন খাতের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিনের কাছে জানতে চাওয়া হয়- গুলশান, বনানী ও মতিঝিল এলাকায় বর্গফুট প্রতি কেমন দরে ফ্লোর বিক্রি হয়। তিনি সমকালকে বলেন, অঞ্চল ও অবস্থানভেদে দরের পার্থক্য আছে। আবার ভবনটি বাণিজ্যিক, না আবাসিক- দর নির্ধারণে তাও বিবেচ্য। তবে এসব এলাকায় সর্বোচ্চ দর গুলশান অ্যাভিনিউ এলাকায়। গুলশান অ্যাভিনিউতে বর্তমানে প্রতি বর্গফুট ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়। আর বনানী এলাকায় পাওয়া যায় ৩০ হাজার টাকা দরে।


আরও পড়ুন

×