রেমিট্যান্স ও রপ্তানি নিয়েই বড় উদ্বেগ

ওবায়দুল্লাহ রনি ও আবু হেনা মুহিব
প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২২ | ১৩:৪৩
বিশ্ব অর্থনীতি এখন মন্দার মুখে। করোনার অভিঘাত, রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানি তেলের বাজারে অস্থিরতার মতো বড় ঘটনায় বিশ্ব অর্থনীতি সংকুচিত হয়ে আসছে। যে হারে এ বছর বিশ্ব অর্থনীতি বাড়বে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল, তা কমিয়ে এনেছে বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফের মতো বহুজাতিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। বিশ্ব অর্থনীতির এ অবস্থার অভিঘাত বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও পড়ছে। আরও অবনতি হলে বাংলাদেশের জন্য মূল উদ্বেগের জায়গা হবে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কমে গেলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে আরও পতন হবে। এতে টাকার মান কমে আমদানি ব্যয়ে বাড়তি চাপ তৈরি হবে।
বৈশ্বিক অস্থিরতায় ভোক্তা পর্যায়ে ভোগ ক্ষমতা কমছে। এতে প্রায় সব দেশেরই রপ্তানি কমছে। গত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশের রপ্তানিতে গতি কমেছে। গত সেপ্টেম্বরে রপ্তানি আগের বছরের একই মাসের চেয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ কম হয়েছে। প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের রপ্তানি কম হয়েছে ৭ শতাংশ। রেমিট্যান্সও গত মাসে কমেছে।
বেশ কয়েকজন রপ্তানিকারক উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নতুন রপ্তানি আদেশ এখন কম। এর চেয়েও বড় সমস্যা, উৎপাদিত পণ্য বুঝে নিচ্ছে না অনেক ক্রেতা এবং ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠান। কারখানায় এসব পণ্য মজুদ করে রাখা বাড়তি ঝামেলা এবং অতিরিক্ত ব্যয় গুনতে হচ্ছে। আবার সরাসরি রপ্তানি আদেশ বাতিল করেছে কিছু ক্রেতা এবং ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠান। এতে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধসহ পরিচালন ব্যয় নিয়ে সংকটে আছে বেশ কিছু কারখানা কর্তৃপক্ষ।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান মনে করেন, বৈশ্বিক মন্দায় দেশের রপ্তানি খাতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। সমকালকে তিনি বলেন, এ রকম একটা পরিস্থিতি যে অপেক্ষা করছে- সে কথা চার মাস আগে থেকেই বলে আসছেন তাঁরা। কিন্তু কেউ তেমন আমলে নেয়নি। গত মাসে রপ্তানি কমে গেছে। আগামীতেও কমার আশঙ্কা করছেন তাঁরা। বৈশ্বিক পরিস্থিতির আশানুরূপ পরিবর্তন না এলে পরের মৌসুম অর্থাৎ নতুন বছরের রপ্তানি নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নেই।
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, টিকে থাকতে বিকল্প কিছু পথ বের করার চেষ্টা করছেন তাঁরা। ইউরোপ ও আমেরিকার সঙ্গে এশিয়ার দেশগুলোতে রপ্তানি বাড়ানো এবং নতুন বাজার পাওয়ার জন্য রপ্তানিকারকরা তৎপর। প্রাকৃতিক তন্তু তুলার পরিবর্তে কৃত্রিম তন্তু বা ম্যান মেড ফাইবারের পোশাক উৎপাদন এবং পণ্যে বৈচিত্র্য আনার মাধ্যমে টিকে থাকার চেষ্টা চলছে। এ পরিস্থিতিতে শিল্পকে টিকিয়ে রাখা, শ্রমিকদের বেতন পরিশোধসহ স্পর্শকাতর বিষয়গুলো মোকাবিলায় সরকারের নীতি সহায়তা বাড়ানো এবং ব্যবসা পরিচালনা মসৃণ করা প্রয়োজন। তাঁরা সরকারের কাছে সহায়তা চেয়েছেন। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, কাস্টমস এবং বন্ড সংক্রান্ত সরকারের সংশ্নিষ্ট বিভাগ ব্যবসা পরিচালনা সহজ করার পরিবর্তে যেন নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এ ছাড়া গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট তো চরমে পৌঁছেছে। এসব বিষয় যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা অত্যন্ত জরুরি।
গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সমকালকে বলেন, ভোক্তা পর্যায়ে চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে রপ্তানি খাত একটা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোর জ্বালানি-সাশ্রয়ী নীতির কারণে সেখানে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ধীর হয়ে এসেছে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রে কর্মসংস্থানের পূর্বাভাস বেশ ইতিবাচক। অর্থাৎ মার্কিন বাজারে আগামীতে চাহিদা বাড়বে। এর পাশাপাশি চীনের সঙ্গে দেশটির বিরোধ এবং পরিবেশ সুরক্ষায় চীন ও ভিয়েতনামের শূন্য কার্বননীতি বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যকে একটা অনুকূল পরিবেশ দেবে। এ সুযোগ কাজে লাগাতে নির্বিঘ্ন শিল্প উৎপাদনে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুতের জোগান দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
রেমিট্যান্স কমে যেতে পারে :বাংলাদেশের আমদানির তুলনায় রপ্তানি এমনিতেই অনেক বেশি। করোনার ধাক্কা কাটিয়ে অর্থনীতিতে যখন গতি ফিরছিল, ঠিক তখনই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এসব কারণে বাণিজ্য ঘাটতি আরও বেড়েছে। ঘাটতি পূরণে সহায়ক প্রবাসী আয় গত অর্থবছরে কমেছে। এসব নিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যে বৈশ্বিক মন্দার শঙ্কা রেমিট্যান্স নিয়ে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসী আয় ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কমে যায়। এর পর চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে বেড়ে ৪১৩ কোটি ডলারে উঠলেও তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে তা কমে ১৫৪ কোটি ডলারে নেমেছে।
ব্যাংকাররা জানান, বৈশ্বিক মন্দা দেখা দিলে রেমিট্যান্স অনেক কমবে। অবশ্য বাংলাদেশি প্রবাসীদের একটি বড় অংশ তুলনামূলক নিম্নমান ও ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের কাজ করেন। এমন অনেক কাজ রয়েছে; মন্দার মধ্যেও জীবন ধারণের জন্য যা আবশ্যক। বৈশ্বিক মন্দা দেখা দিলে এ ধরনের কাজে মজুরি কমলেও একেবারে কাজ হারানোর ঝুঁকি কম। ফলে কাজ হারিয়ে দেশে ফেরার মতো ঘটনা হয়তো তেমন দেখা যাবে না। তবে ভালোভাবে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে প্রস্তুতি নিতে হবে।
ব্যাংক এশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী সমকালকে বলেন, চলমান যুদ্ধসহ বিভিন্ন কারণে ২০২৩ সালে একটা বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে। মন্দা হলে অন্য সব খাতের মতো রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, বিশ্ব অর্থনীতির ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে কৃচ্ছ্র সাধনের মাধ্যমে আগাম সতর্ক হতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্নিষ্ট এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, মন্দার আশঙ্কা সত্যি হলে বিদেশে শ্রমিক যাওয়া কমবে। আয়েও তার প্রভাব পড়বে। তবে প্রবাসীদের আয়ের একটি অংশ হুন্ডিসহ বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলে দেশে আসে। প্রবাসীদের বেশিরভাগ আয় বৈধ উপায়ে দেশে আনার চেষ্টা চলছে। সমস্যা চিহ্নিত করতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের তিনটি প্রতিনিধি দল সম্প্রতি সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইতালি সফর করেছে। এসব প্রতিনিধি দল শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে এখন প্রতিবেদন দেবে। প্রবাসী আয়ের বেশিরভাগ ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে আনা গেলে মন্দা হলেও রেমিট্যান্সের ওপর নেতিবাচক প্রভাব তেমন নাও পড়তে পারে।
- বিষয় :
- রেমিট্যান্স