সংস্কার নিশ্চিত করেই ঋণ দেবে আইএমএফ
জাকির হোসেন
প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০২২ | ১৩:৩৭
বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষা এবং বাজেট সহায়তা হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ নেওয়ার বিষয়ে আজ বুধবার ঢাকায় আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হচ্ছে। আইএমএফের প্রতিনিধি দল দুই সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করবে। তারা বেসরকারি খাত এবং কয়েকটি গবেষণা সংস্থার সঙ্গেও বৈঠক করবে।
বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা সফল হলে আইএমএফ তাদের এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ) এবং নতুন কর্মসূচি রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনিবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় ঋণ দেবে। আইএমএফের এ কর্মসূচির আওতায় ঋণ পেতে হলে উচ্চ মাত্রার সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। এ কর্মসূচি সম্পর্কে সংস্থাটির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এর আওতায় ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সুবিন্যস্ত শর্তাবলি রয়েছে। এসব শর্ত সংস্কারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর আওতায় প্রতিটি কিস্তি ছাড়ের আগে প্রয়োজনীয় সংস্কার নিশ্চিত করতে হবে।
গত জুলাই মাসে আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়ে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। এর আগে আইএমএফের 'আর্টিকেল-ফোর' নামে অর্থনীতির অবস্থা পর্যালোচনার মিশন ঢাকায় আসে। ওই মিশনের সমাপনী বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পাশাপাশি তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) এবং বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর চিন্তা-ভাবনা করছে। আইএমএফ মনে করছে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে সুরক্ষা দেওয়া খুব জরুরি। কারণ, বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য বেশ চাপের মধ্যে আছে। এ ছাড়া আর্থিক খাতে সংস্কার জরুরি। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমাতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী শ্রেণিকরণ ও প্রভিশনিং চায় সংস্থাটি। এ ছাড়া ভ্যাটের হার কাঠামো সহজ করা, পুরো রাজস্ব সংগ্রহ পদ্ধতির আধুনিকায়নসহ রাজস্ব প্রশাসনে আরও সংস্কার আনার কথা তারা সাম্প্রতিক সময়ে বলে আসছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্নিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে জানান, আইএমএফের কাছে সরকার ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে। তবে তাদের কর্মসূচির আওতায় ৬৮০ কোটি ডলার পর্যন্ত ঋণ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। সম্ভাব্য ৯টি কিস্তিতে তারা তিন বছর ধরে ঋণ দিতে পারে। ঋণ পরিশোধের মেয়াদ হতে পারে ২০ বছরের মতো এবং এর মধ্যে বেশ কয়েক বছর গ্রেস পিরিয়ড থাকবে। এর মানে প্রথম কিস্তি শুরু হওয়ার আগে লম্বা সময় পাওয়া যাবে। আইএমএফের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, আরএসএফ তহবিল থেকে নেওয়া ঋণের মেয়াদ ২০ বছর এবং গ্রেস পিরিয়ড সাড়ে ১০ বছর। এ ঋণে সংস্কারের শর্ত থাকলেও সুদের হার নমনীয়।
তিনি আরও জানান, আইএমএফ সাম্প্রতিক সময়ে যেসব সংস্কারের কথা বলে আসছে, ঋণের বিষয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে সেগুলোর সবই যে থাকবে, তা নয়। কিছু বিষয় নতুন করে যুক্ত হতে পারে। এ ছাড়া আরএসএফ কর্মসূচির প্রধান উদ্দেশ্য জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে সহায়তা করা। ঋণের আলোচনায় জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় কার্বন কর আরোপসহ কিছু সংস্কারের সুপারিশ আসতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল গত ১০ থেকে ১৬ অক্টোবর ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বার্ষিক সভায় যোগ দেয়। জানা গেছে, বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে আইএমএফের কর্মকর্তারা বলেছেন, তাঁরা ঋণ দিতে আগ্রহী। তবে আর্থিক খাত এবং রাজস্ব প্রশাসনসহ তাঁরা কিছু ক্ষেত্রে সংস্কার চান।
এর আগে আইএমএফের এক অবস্থান পত্রে বলা হয়, পর্যাপ্ত রাজস্ব আয়ের অভাব এবং উচ্চ ভর্তুকির কারণে বাজেটের ঘাটতি অর্থায়ন করতে অভ্যন্তরীণ উৎসের উচ্চ মূল্যের ঋণের দিকে সরকারের নির্ভরশীলতা বেড়েছে। এ কারণে আর্থিক স্বস্তির জায়গা সংকুচিত হচ্ছে। এ অবস্থায় আর্থিকভাবে টেকসই উপায়ে উন্নয়ন, সামাজিক এবং জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে রাজস্ব আয় বাড়ানো এবং সরকারের ব্যয় যৌক্তিকীকরণ এ সময়ের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। তবে দরিদ্র ও ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীকে করোনা এবং বৈশ্বিক অভিঘাত মোকাবিলার জন্য সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে।
গত আগস্ট মাসে সরকার সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়ায়। সরকারের এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে আইএমএফের ঋণ পাওয়ার শর্ত জড়িত থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়। তবে আইএমএফের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তাদের সঙ্গে ঋণ আলোচনা শুরু হয়নি। সরকারের এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে আইএমএফের কোনো সংশ্নিষ্টতা নেই।
উচ্চ আমদানি ব্যয়ের চাপে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কয়েক মাস ধরে কমছে। বর্তমান রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে। এক বছর আগের তুলনায় যা অন্তত ১০ বিলিয়ন ডলার কম। এদিকে বৈশ্বিক অনিশ্চিত পরিস্থিতি এবং মন্দার আশঙ্কায় সাম্প্রতিক সময়ে রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে ধীর গতি দেখা দিয়েছে। এ কারণে রিজার্ভ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। সরকার খরচ সামলাতে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন কম করছে। এ অবস্থায় আইএমএফের ঋণের বিষয়ে রাজনৈতিক মহলেও আলোচনা হচ্ছে।
মিশনের কর্মসূচি :ঢাকা সফররত আইএমএফ মিশনের নেতৃত্ব দেবেন সংস্থাটির এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দ। প্রতিনিধি দল আজ বৈঠক করবে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সঙ্গে। কাল বৃহস্পতিবার পুরোদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের কথা রয়েছে। আগামী রোববার এনবিআর, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বসবেন আইএমএফ কর্মকর্তারা। পরদিন আবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক হবে। এ ছাড়া বাকি দিনগুলোতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শেয়ারাবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডসহ সরকারি কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা। বেসরকারি খাতের মধ্যে বিজিএমইএসহ কয়েকটি বাণিজ্য সংগঠন এবং গবেষণা সংস্থার মধ্যে সিপিডি ও পিআরআইর সঙ্গে বৈঠক করবে আইএমএফ মিশন।