সুদহারে সীমা প্রত্যাহার চায় আইএমএফ
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২২ | ১৩:৪৬
ঋণ ও আমানতে সুদহারে আরোপিত সীমা প্রত্যাহার চায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ। বর্তমানে ঋণে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ এবং ব্যক্তি পর্যায়ের মেয়াদি আমানতে গড় মূল্যস্ম্ফীতির চেয়ে বেশি সুদ দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। মূল্যস্ম্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে উঠলেও সুদহারে সীমা তুলে দেওয়ার বিষয়ে অর্থনীতিবিদ অনেকেই পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন।
গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত মোট ছয়টি সেশনে বিভিন্ন বিষয়ে বৈঠক করে সফররত আইএমএফ মিশন। মিশনের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধি দল আগামী ৯ নভেম্বর পর্যন্ত অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করবে। বাংলাদেশ সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ চাওয়ার পর আনুষ্ঠানিক আলোচনার জন্য এ মিশন ঢাকায় এসেছে।
জানা গেছে, আইএমএফ মিশন বলেছে, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সুদহার বাজারভিত্তিক হওয়া উচিত। এ ছাড়া ঋণের সুদহার এত কম রেখে মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে। চাহিদা ব্যবস্থাপনার জন্য সুদহার বাড়ানো প্রয়োজন। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গতকাল এক প্রকাশনায় বলা হয়েছে, সুদের হার সীমা বেঁধে দেওয়ায় বিনিয়োগসহ অর্থনীতিতে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সুদহারকে একটি লক্ষ্যভিত্তিক করার কথা বলেছে আইএমএফ। এ ছাড়া আগামীতে প্রতিবছর চারবার মুদ্রানীতি প্রকাশের লক্ষ্যে আপাতত বছরে দুইবার ঘোষণা করতে বলা হয়েছে। আগে ৬ মাস অন্তর মুদ্রানীতির ভঙ্গি ঘোষণা করত বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে সাবেক গভর্নর ফজলে কবির দায়িত্ব নেওয়ার পর বছরে একবার মুদ্রানীতি ঘোষণা শুরু করেন।
সূত্র জানায়, সুদহারের সীমাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হলেও গতকাল তিনটি সেশনে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে বাংলাদেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টের হিসাব পদ্ধতি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয়ের প্রক্ষেপণ, আমদানি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। একটি সেশনে আইএমএফ প্রতিনিধি দলকে জানানো হয়, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হিসাব প্রকাশের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা করে কবে নাগাদ শুরু করা হবে, তা সিদ্ধান্ত হবে। আইএমএফের পদ্ধতি অনুসরণের পাশাপাশি শুরুতে বিদ্যমান পদ্ধতির হিসাবও প্রকাশ করা হবে। আইএমএফের বিবেচনায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের আলোকে বাংলাদেশের বর্তমান রিজার্ভ সাড়ে ২৭ বিলিয়ন ডলারের কম। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গতকালের রিজার্ভ ছিল ৩৫ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার।
জানা গেছে, বৈঠকে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণের বিষয়ে আলোচনা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে,গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার ব্যাপক দরপতন হয়েছে। ডলার সংগ্রহে এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলো নিজেরাই বসে একটি দর ঠিক করেছে। মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এই মুহূর্তে এর চেয়ে ভালো বিকল্প ছিল না। গত মাস থেকে আন্তঃব্যাংকে ডলার বেচাকেনার প্রকৃত দর প্রকাশ করা হচ্ছে। এত দিন ব্যাংকগুলোর কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে দরে ডলার বিক্রি করত সেটিকে আন্তঃব্যাংক দর হিসেবে প্রকাশ করা হতো। বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে প্রতি ডলার ৯৭ টাকা দরে বিক্রি করছে। অথচ বুধবার আন্তঃব্যাংকে সর্বনিম্ন ১০০ টাকা ৫২ পয়সা এবং সর্বোচ্চ ১০৩ টাকা ৫৬ পয়সায় ডলার বেচাকেনা হয়।
জানা গেছে, বৈঠকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নিম্নমুখী প্রবণতার এ সময়ে ডলার বিক্রির কারণ জানতে চায় আইএমএফ। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে- সার, জ্বালানিসহ খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু পণ্য আমদানির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করছে, মোট আমদানির তুলনায় যা খুব সামান্য।
জানা গেছে, আইএমএফ প্রতিনিধি দল মনে করে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমলেও তা এখনও উদ্বেগজনক পর্যায়ে নামেনি। তবে ধারাবাহিকভাবে কমার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসার কৌশল নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, তুলনামূলক কম প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি কমাতে এরই মধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত রপ্তানিতে ধীরগতি থাকলেও জানুয়ারি থেকে বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর চলতি অর্থবছর ২৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আয়ের আশা করা হয়। আইএমএফ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই প্রত্যাশার সঙ্গে একমত পোষণ করে জানিয়েছে, তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে আগামীতে রেমিট্যান্স বাড়তে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আবুল কালাম আজাদ সাংবাদিকদের বলেন, আইএমএফের সঙ্গে বাংলাদেশের এক্সটেন্ডডে ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি, র্যাপিড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি ও র্যাপিড ফাইন্যান্সিং ইনস্ট্রুমেন্ট- এই তিন ধরনের অ্যারেজমেন্ট রয়েছে। প্রতিটি অ্যারেজমেন্টের আওতায় দেড় বিলিয়ন করে মোট সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার পাওয়ার আশা করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আইএমএফ মিশনের অত্যন্ত ফলপ্রসূ আলোচনা চলছে। সুদহার, রিজার্ভ, সামষ্টিক অর্থনীতি, ব্যাংকিংসহ বিভিন্ন বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।
জানা গেছে, ইডিএফসহ বিভিন্ন তহবিলে সরবরাহ করা প্রায় সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলারকেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাবে দেখাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হিসাব পদ্ধতি অনুসরণ বিষয়ে গত বছর থেকে বলে আসছে সংস্থাটি।