বিশেষজ্ঞ মত
জড়িতদের কঠোর শাস্তি হলে প্রতারণা কমবে

আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান
প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২৩ | ১৮:০০
কষ্ট না করে রাতারাতি ধনী হতে চাওয়া মানুষের অভাব নেই। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই কমবেশি এমন মানুষ থাকেন। আমাদের মতো দেশে এদের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। সাধারণ মানুষের এ মানসিকতাকে পুঁজি করে কিছু খারাপ মানুষ ‘পঞ্জি স্কিম’ গড়ে তোলে। লোভী মানুষই পঞ্জি স্কিমের ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব হারান।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) দায়িত্ব পালনের সময় বেশ কিছু পঞ্জি স্কিমের ঘটনার বিষয়ে কাজ করেছি। বেশির ভাগ ঘটনায় অভিজ্ঞতা হলো, আর্থিক বিষয়ে কম শিক্ষিত বা অসচেতন মানুষ পঞ্জি স্কিমের শিকার হন বেশি। তবে এমনও অভিজ্ঞতা হয়েছে, বহু শিক্ষিত মানুষ হঠাৎ ধনী হওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে পঞ্জি স্কিমে টাকা দিয়েছেন।
অতি লোভ কখনোই ভালো নয়– এ কথা যারা ভুলে যান, তারাই বেশি প্রতারিত হন। বছরে বা ছয় মাসে দ্বিগুণ অর্থ দেওয়া কোনো ব্যবসায়ই সম্ভব নয়। অথচ এমন প্রলোভন দেয় কারসাজি চক্র। যারা এমন মুনাফার লোভে পড়েন, তারা এটুকু বোঝার চেষ্টা করেন না যে, এত মুনাফা আদৌ বাস্তবসম্মত কিনা। যিনি মুনাফা দেওয়ার কথা বলছেন, তিনি কোথা থেকে বড় অঙ্কের মুনাফা দেবেন– তা নিয়ে বাস্তবসম্মত চিন্তা করেন না। বিশ্বে এমন কি ব্যবসা আছে, যেখানে ছয় মাসে দ্বিগুণের বেশি মুনাফা করা সম্ভব।
এই চিন্তা মাথায় না আসার অবশ্য কারণ আছে। সব পঞ্জি স্কিমই শুরুতে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মুনাফা দেয়। নতুন একজনের কাছ থেকে তারা যে টাকা পায়, তা আগেরজনকে মুনাফাসহ ফেরত দেয়। এতে মানুষের মধ্যে বিশ্বাস তৈরি হয়। তা ছাড়া এসব স্কিমে নিজে লগ্নি করার পাশাপাশি অন্যকে যুক্ত করতে পারলে মুনাফার লোভ দেখানো হয়। ফলে যারা শুরুতে টাকা দেন, পরে তারা নিকটজনসহ পরিচিতদেরও যুক্ত করেন। এক সময় মূলহোতাদের হাতে যখন অনেক টাকা আসে এবং নতুন করে যুক্ত হওয়া মানুষের সংখ্যা কমে যায়, তখন সবার টাকা নিয়ে তারা আত্মগোপন করে। প্রতিটি পঞ্জি স্কিমে এটি ‘কমন’ ব্যাপার।
পঞ্জি স্কিমের মাধ্যমে প্রতারণার বিষয়টি নতুন নয়। মাঝেমাঝেই এমন প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় বহু লেখালেখি হয়। মানুষের মধ্যে এ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। কিছুদিন পর সবাই তা ভুলে যান। এর পর নতুন পঞ্জি স্কিম আসে এবং হাজার হাজার মানুষ প্রতারিত হয়ে শত শত কোটি টাকা হারান।
প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে এর কোনো প্রতিকার নেই। অবশ্যই আছে। প্রথমত, মানুষকে সচেতন হতে হবে। দ্বিতীয়ত, সরকার এবং রাষ্ট্রব্যবস্থায় যাদের ওপর এ প্রতারণা প্রতিরোধ করার দায়িত্ব, তাদের নিয়মিতভাবে মানুষকে সচেতন করার পর্যাপ্ত কার্যক্রম চালাতে হবে। শুধু সচেতনতা বাড়ানো নয়, এ ধরনের কোনো প্রতারণা হচ্ছে কিনা, তা নিয়মিত নজরদারি করতে হবে। যারা প্রতারণা করে, তারা স্মার্ট। তারা নিত্যনতুন পন্থা অবলম্বন করে। বিদ্যমান সার্ভিল্যান্স ব্যবস্থাকে ফাঁকি দেওয়ার ব্যবস্থা করেই তারা প্রতারণার ফাঁদ ফেলে। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে যাদের এ বিষয়ে দায়িত্ব রয়েছে, তাদের অধিক স্মার্ট হতে হবে। এখন যেহেতু অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে এ ধরনের প্রতারণা বেশি হচ্ছে, সেহেতু অনলাইন সার্ভিল্যান্স বাড়াতে হবে। মাঠ পর্যায়েও নিয়মিত গোয়েন্দা তথ্য নিতে হবে। আজ যে প্রতারণা বন্ধ হলো, কাল আরেকটি শুরু হবে না– তার নিশ্চয়তা নেই। তাই নজরদারি সার্বক্ষণিক হতে হবে।
এ ছাড়া প্রতারণা প্রতিরোধের বড় হাতিয়ার হলো জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুততম সময়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। কঠোর শাস্তি হলে এবং তার প্রচার হলে কিছুটা হলেও প্রতারণা কমবে। তবে শেষ পর্যন্ত মানুষ সচেতন না হলে প্রতারণা বন্ধ করা কঠিন।
লেখক- সাবেক বিএফআইইউ প্রধান
- বিষয় :
- প্রতারণা