- অর্থনীতি
- টাকা ছাপিয়ে ঘাটতি মেটানো যেতে পারে
আসছে বাজেট :বিশেষজ্ঞ মত
টাকা ছাপিয়ে ঘাটতি মেটানো যেতে পারে

বিশ্বের সব দেশের জাতীয় বাজেট এক অর্থে গতানুগতিকই হয়। কতটুকু ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে, আয় কতটুকু হবে এবং ঘাটতি কতটুকু হচ্ছে ও কীভাবে ঘাটতি অর্থায়ন হবে- এ নিয়ে যত কথা। এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হলো, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কতটা ধরা হচ্ছে। প্রতি বছর ব্যয় বরাদ্দের ক্ষেত্রে সাধারণত গতানুগতিক ধারা থাকে। কিন্তু পরিবর্তিত কোনো বিশেষ পরিস্থিতির কারণে বিশেষ কোনো বরাদ্দ বৃদ্ধির পাশাপাশি তা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে থাকতে পারে। আমরা এখন এমনই এক বিশেষ পরিস্থিতির মধ্যে আছি।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের সূত্রে জানতে পারছি, ৮ দশমিক ২০ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরে এ বছর সরকার বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে। এ সময়ে এত প্রবৃদ্ধি আমার কাছে বাস্তবতাবর্জিত বলে মনে হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বিষয়ে আইএমএফের একটি প্রতিবেদন দেখলাম। সেখানে বলা হয়েছে, ৫ থেকে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। করোনা সংকটের এ সময়ে কোনোভাবেই মনে করি না, ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। এমনকি আইএমএফের পূর্বাভাসও শেষ পর্যনন্ত অর্জন হবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। প্রবৃদ্ধি কত হবে তা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে বর্তমান করোনা সংকট পরিস্থিতি কতদিন স্থায়ী হয় তার ওপর। আমার ঠিক মনে হয়, করোনা সংকট উত্তরণে যতটুকু দক্ষতার স্বাক্ষর রাখা প্রয়োজন ছিল, ততটুকু আমরা দেখাতে পারছি না। অর্থাৎ সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ার শঙ্কা আছে।
আগামী বাজেট বিষয়ে গণমাধ্যম থেকে যে তথ্য পাচ্ছি তা যদি সঠিক হয় তবে বলব, কিছুটা বাস্তবতাবর্জিত বাজেট হতে যাচ্ছে। প্রথম কারণ হলো, জিডিপির প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন ঠিক নেই। জিডিপির সঙ্গে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও রাজস্ব আদায়ের প্রক্ষেপণ বাস্তবসম্মত নয়। ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়ার চিন্তাও ভালো মনে হচ্ছে না। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ছে। কিন্তু যতটা বাড়ছে তা যথেষ্ট কিনা, তা নিয়ে এখনই মন্তব্য করা মুশকিল। তবে বরাদ্দ বাড়ানো যৌক্তিক। বাজেট বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যদি মনে হয়, এ খাতের আরও বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন; সরকার চাইলেই তা করতে পারবে।
আমাদের দেশে প্রতি বছর বড় বাজেট ঘোষণার একটা রেওয়াজ হয়ে গেছে। এবং প্রতি বছরই ওই বড় বাজেট বাস্তবায়ন হয় না এবং বড় ঘাটতি থাকে। এ কারণে প্রতি বছরই মূল বাজেটের বড় সংশোধন অর্থাৎ কাট-ছাঁট করা হয়। এবারও বড় ঘাটতি হবে। এ নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। বললেও সরকার এমন করবে; না বললেও করবে। ঘাটতির কারণ সরকারের রাজস্ব আদায়ে বড় দুর্বলতা। রাজস্ব আদায় করে মূলত এনবিআর। রাজস্ব আদায়ের বড় খাত ভ্যাট। করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে যে স্থবির অবস্থা চলছে, তাতে ভ্যাট আদায় কমবে। তা ছাড়া আমদানি কমার কারণে এখান থেকে শুল্ক্ক আদায় বাড়ার সম্ভাবনা কম। রাজস্ব আয়ের আর একটি খাত হচ্ছে ব্যক্তি কর ও প্রাতিষ্ঠানিক কর থেকে প্রত্যক্ষ রাজস্ব আদায়। কিন্তু চলতি সংকটের কারণে সবাই প্রণোদনা বা কর মওকুফ চাইছে। এ খাত থেকেও রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির সম্ভাবনা কম। ফলে বড় বাজেটের জন্য বড় রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে যে বাজেট করতে যাচ্ছে, তা বাস্তবায়ন হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
আগামী অর্থবছরেও রাজস্ব আদায়ের হার নিম্নমুখী থাকবে। কিন্তু সরকারের ব্যয় খুব একটা কমবে না। অর্থাৎ বাজেট ঘাটতি বাড়বে। এ নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই। জিডিপির তুলনায় বাজেট ঘাটতি ৬ থেকে ৭ শতাংশ রাখা যেতে পারে। প্রশ্ন হলো, ঘাটতি বাজেটের অর্থ কোথা থেকে সংগ্রহ হবে। গণমাধ্যমের খবর থেকে জানতে পারছি, প্রথাগতভাবে সরকার ব্যাংক ঋণের ওপরেই ভরসা রাখতে যাচ্ছে। প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। যখন বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কম, তখন সরকার বড় অঙ্কের ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি আরও কমবে। তাতে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি বাধাগ্রস্ত হবে।
এ সমস্যা সরকার চাইলে অন্যভাবে মেটাতে পারে। আমি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটানোর কথা বলছি। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে দিতে হতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমি এ পন্থাকে সমর্থন করি। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ মনে করেন, এ কারণে মূল্যস্টম্ফীতি বাড়তে পারে। আমি এতে দ্বিমত পোষণ করি। কারণ করোনা সংকটের কারণে সার্বিক চাহিদা অনেক কমেছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ কম এবং মানুষের আয়-উপার্জন কমেছে। ফলে চাহিদাও অনেকাংশে কমেছে। ফলে কিছুটা অর্থ সরবরাহ বাড়লেও মূল্যস্টম্ফীতি খুব একটা বাড়বে না। চাইলে বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নিয়েও বাজেট ঘাটতি মেটাতে পারে। যতটুকু জানি, সরকার এ বিষয়ে সচেষ্ট এবং বেশ কিছু প্রতিশ্রুতিও সরকার পেয়েছে। তবে সময়মতো বৈদেশিক উৎস থেকে সাহায্য পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে।
এবার যেহেতু স্বাস্থ্যঝুঁকি সংক্রান্ত বিশেষ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে; ফলে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ অনেক বাড়াতে হবে। কারণ চিকিৎসা সরঞ্জাম, অবকাঠামোসহ জনবল খাতে বেশি অর্থ লাগবে। দ্বিতীয়ত, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অনেক বেশি বাড়াতে হবে। করোনার কারণে অনেক লোক চাকরি হারাবে। নিম্ন-মধ্যবিত্ত অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাবে। ব্র্যাক, পিপিআরসিসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান জরিপ করে এ বিষয়ে তাদের গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এসব মানুষকে খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ থাকতে হবে। এই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি কেবল গ্রামকেন্দ্রিক নয়, এবার শহরেও আনতে হবে। আমি অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালে ১শ' দিনের কর্মসংস্থান কর্মসূচি নিয়েছিলাম। সরকার এটি চালু রেখেছে। এর আওতা বাড়ানো হতে পারে। তবে এ কর্মসূচি যেন শুধু 'খাল কাটা'র মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। প্রবাসী অনেকে চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরবেন। তাদের দিকেও বিশেষ নজর দিতে হবে। তৃতীয়ত, কৃষিতেও স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বরাদ্দ দিতে হবে, যাতে সংকটময় এ সময়ে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে না পড়ে।
তবে বাজেটের মূল সমস্যা হলো, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ অনেক মন্ত্রণালয় সময়মতো তাদের বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে বাজেট বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে মনে করি। আমি দেখেছি, আমলাতন্ত্রের সিনিয়র কর্মকর্তা পর্যায়ে জবাবদিহির অভাব আছে। অভিজ্ঞতা ও দক্ষতারও বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। ভালো কাজের জন্য স্বীকৃতিসহ ভালো প্রণোদনা এবং খারাপ কাজের জন্য শাস্তি ও জবাবদিহি না করার সংস্কৃতি যতদিন বহাল থাকবে, ততদিন এ পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠা কঠিন কোনো কাজ নয়। এ ছাড়া দুর্নীতিও বাজেট বাস্তবায়নে বড় বাধা। যদিও ইদানীং দুর্নীতি দমন কমিশন এ নিয়ে কিছু কাজ করছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে দুর্নীতি অনেক কমানো সম্ভব। হয়তো রাতারাতি সবটা দূর করা যাবে না।
করোনা সংকটের কারণে শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এমন পরিস্থিতি ভবিষ্যতে কখনও হলে, তখন যাতে একই পরিস্থিতি তৈরি না হয়, তার জন্য ধীরে ধীরে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। অনলাইন পাঠদান ব্যবস্থা শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত এবং প্রাইমারি থেকে উচ্চশিক্ষার সব শিক্ষার্থী যাতে পেতে পারে তার জন্য অবকাঠামো করতে হবে। বাজেটে এ বিষয়টি আসা উচিত।
লেখক :সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা
বিভিন্ন গণমাধ্যমের সূত্রে জানতে পারছি, ৮ দশমিক ২০ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরে এ বছর সরকার বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে। এ সময়ে এত প্রবৃদ্ধি আমার কাছে বাস্তবতাবর্জিত বলে মনে হয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বিষয়ে আইএমএফের একটি প্রতিবেদন দেখলাম। সেখানে বলা হয়েছে, ৫ থেকে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। করোনা সংকটের এ সময়ে কোনোভাবেই মনে করি না, ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। এমনকি আইএমএফের পূর্বাভাসও শেষ পর্যনন্ত অর্জন হবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। প্রবৃদ্ধি কত হবে তা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে বর্তমান করোনা সংকট পরিস্থিতি কতদিন স্থায়ী হয় তার ওপর। আমার ঠিক মনে হয়, করোনা সংকট উত্তরণে যতটুকু দক্ষতার স্বাক্ষর রাখা প্রয়োজন ছিল, ততটুকু আমরা দেখাতে পারছি না। অর্থাৎ সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ার শঙ্কা আছে।
আগামী বাজেট বিষয়ে গণমাধ্যম থেকে যে তথ্য পাচ্ছি তা যদি সঠিক হয় তবে বলব, কিছুটা বাস্তবতাবর্জিত বাজেট হতে যাচ্ছে। প্রথম কারণ হলো, জিডিপির প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন ঠিক নেই। জিডিপির সঙ্গে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও রাজস্ব আদায়ের প্রক্ষেপণ বাস্তবসম্মত নয়। ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়ার চিন্তাও ভালো মনে হচ্ছে না। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ছে। কিন্তু যতটা বাড়ছে তা যথেষ্ট কিনা, তা নিয়ে এখনই মন্তব্য করা মুশকিল। তবে বরাদ্দ বাড়ানো যৌক্তিক। বাজেট বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যদি মনে হয়, এ খাতের আরও বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন; সরকার চাইলেই তা করতে পারবে।
আমাদের দেশে প্রতি বছর বড় বাজেট ঘোষণার একটা রেওয়াজ হয়ে গেছে। এবং প্রতি বছরই ওই বড় বাজেট বাস্তবায়ন হয় না এবং বড় ঘাটতি থাকে। এ কারণে প্রতি বছরই মূল বাজেটের বড় সংশোধন অর্থাৎ কাট-ছাঁট করা হয়। এবারও বড় ঘাটতি হবে। এ নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। বললেও সরকার এমন করবে; না বললেও করবে। ঘাটতির কারণ সরকারের রাজস্ব আদায়ে বড় দুর্বলতা। রাজস্ব আদায় করে মূলত এনবিআর। রাজস্ব আদায়ের বড় খাত ভ্যাট। করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে যে স্থবির অবস্থা চলছে, তাতে ভ্যাট আদায় কমবে। তা ছাড়া আমদানি কমার কারণে এখান থেকে শুল্ক্ক আদায় বাড়ার সম্ভাবনা কম। রাজস্ব আয়ের আর একটি খাত হচ্ছে ব্যক্তি কর ও প্রাতিষ্ঠানিক কর থেকে প্রত্যক্ষ রাজস্ব আদায়। কিন্তু চলতি সংকটের কারণে সবাই প্রণোদনা বা কর মওকুফ চাইছে। এ খাত থেকেও রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির সম্ভাবনা কম। ফলে বড় বাজেটের জন্য বড় রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে যে বাজেট করতে যাচ্ছে, তা বাস্তবায়ন হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
আগামী অর্থবছরেও রাজস্ব আদায়ের হার নিম্নমুখী থাকবে। কিন্তু সরকারের ব্যয় খুব একটা কমবে না। অর্থাৎ বাজেট ঘাটতি বাড়বে। এ নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই। জিডিপির তুলনায় বাজেট ঘাটতি ৬ থেকে ৭ শতাংশ রাখা যেতে পারে। প্রশ্ন হলো, ঘাটতি বাজেটের অর্থ কোথা থেকে সংগ্রহ হবে। গণমাধ্যমের খবর থেকে জানতে পারছি, প্রথাগতভাবে সরকার ব্যাংক ঋণের ওপরেই ভরসা রাখতে যাচ্ছে। প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। যখন বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কম, তখন সরকার বড় অঙ্কের ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি আরও কমবে। তাতে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি বাধাগ্রস্ত হবে।
এ সমস্যা সরকার চাইলে অন্যভাবে মেটাতে পারে। আমি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটানোর কথা বলছি। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে দিতে হতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমি এ পন্থাকে সমর্থন করি। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ মনে করেন, এ কারণে মূল্যস্টম্ফীতি বাড়তে পারে। আমি এতে দ্বিমত পোষণ করি। কারণ করোনা সংকটের কারণে সার্বিক চাহিদা অনেক কমেছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ কম এবং মানুষের আয়-উপার্জন কমেছে। ফলে চাহিদাও অনেকাংশে কমেছে। ফলে কিছুটা অর্থ সরবরাহ বাড়লেও মূল্যস্টম্ফীতি খুব একটা বাড়বে না। চাইলে বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নিয়েও বাজেট ঘাটতি মেটাতে পারে। যতটুকু জানি, সরকার এ বিষয়ে সচেষ্ট এবং বেশ কিছু প্রতিশ্রুতিও সরকার পেয়েছে। তবে সময়মতো বৈদেশিক উৎস থেকে সাহায্য পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে।
এবার যেহেতু স্বাস্থ্যঝুঁকি সংক্রান্ত বিশেষ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে; ফলে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ অনেক বাড়াতে হবে। কারণ চিকিৎসা সরঞ্জাম, অবকাঠামোসহ জনবল খাতে বেশি অর্থ লাগবে। দ্বিতীয়ত, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অনেক বেশি বাড়াতে হবে। করোনার কারণে অনেক লোক চাকরি হারাবে। নিম্ন-মধ্যবিত্ত অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাবে। ব্র্যাক, পিপিআরসিসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান জরিপ করে এ বিষয়ে তাদের গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এসব মানুষকে খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ থাকতে হবে। এই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি কেবল গ্রামকেন্দ্রিক নয়, এবার শহরেও আনতে হবে। আমি অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালে ১শ' দিনের কর্মসংস্থান কর্মসূচি নিয়েছিলাম। সরকার এটি চালু রেখেছে। এর আওতা বাড়ানো হতে পারে। তবে এ কর্মসূচি যেন শুধু 'খাল কাটা'র মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। প্রবাসী অনেকে চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরবেন। তাদের দিকেও বিশেষ নজর দিতে হবে। তৃতীয়ত, কৃষিতেও স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি বরাদ্দ দিতে হবে, যাতে সংকটময় এ সময়ে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে না পড়ে।
তবে বাজেটের মূল সমস্যা হলো, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ অনেক মন্ত্রণালয় সময়মতো তাদের বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে বাজেট বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে মনে করি। আমি দেখেছি, আমলাতন্ত্রের সিনিয়র কর্মকর্তা পর্যায়ে জবাবদিহির অভাব আছে। অভিজ্ঞতা ও দক্ষতারও বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। ভালো কাজের জন্য স্বীকৃতিসহ ভালো প্রণোদনা এবং খারাপ কাজের জন্য শাস্তি ও জবাবদিহি না করার সংস্কৃতি যতদিন বহাল থাকবে, ততদিন এ পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠা কঠিন কোনো কাজ নয়। এ ছাড়া দুর্নীতিও বাজেট বাস্তবায়নে বড় বাধা। যদিও ইদানীং দুর্নীতি দমন কমিশন এ নিয়ে কিছু কাজ করছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে দুর্নীতি অনেক কমানো সম্ভব। হয়তো রাতারাতি সবটা দূর করা যাবে না।
করোনা সংকটের কারণে শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এমন পরিস্থিতি ভবিষ্যতে কখনও হলে, তখন যাতে একই পরিস্থিতি তৈরি না হয়, তার জন্য ধীরে ধীরে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। অনলাইন পাঠদান ব্যবস্থা শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত এবং প্রাইমারি থেকে উচ্চশিক্ষার সব শিক্ষার্থী যাতে পেতে পারে তার জন্য অবকাঠামো করতে হবে। বাজেটে এ বিষয়টি আসা উচিত।
লেখক :সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা
মন্তব্য করুন