দরিদ্র ও ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর সহায়তায় সরকার প্রতিবছর সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ায়। কিন্তু বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার সীমাবদ্ধতা ও অদক্ষতার ফলে এসব কর্মসূচির প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থের অপচয় হচ্ছে।

কয়েকটি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ওপর বিশ্বব্যাংক পরিচালিত এক জরিপের পর্যবেক্ষণ এমনই। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর গুরুত্বপূর্ণ আটটি কর্মসূচির বাস্তবায়ন ও এর প্রভাবের ওপর জরিপ করেছে। দরিদ্র নারীদের মাতৃত্বকালীন ভাতা, উপার্জনমুখী কর্মসূচি 'যত্ন', ভিজিএফ ও ভিজিডি, বয়স্ক ভাতা, বিধবা, স্বামীপরিত্যক্ত ও নিগৃহীত নারীর ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা ও দরিদ্রদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির কর্মসূচির ওপর জরিপটি পরিচালিত হয়। এসব কর্মসূচি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্মসূচিগুলোর মধ্যে সমন্বয় ও বাস্তবায়ন দক্ষতার অভাবে একই ব্যক্তি যেমন একাধিক সুবিধা পাচ্ছে আবার অনেকে সুবিধা পাওয়ার উপযোগী হয়েও পাচ্ছে না। অধিকাংশ কর্মসূচি ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হয়, সেখানে প্রশাসনিক দুর্বলতা ব্যাপক। ইউনিয়ন পরিষদ সুবিধাভোগী চিহ্নিত করার কাজ করে। কিন্তু এজন্য তাদের কোনো বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয় না। বিশ্বব্যাংক মনে করে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সুন্দরভাবে সাজানো গেলে এবং যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হলে তা দারিদ্র্য দূর করতে আরও কার্যকরভাবে প্রভাব ফেলতে পারে। স্থানীয় সরকারকে কারিগরি ও আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে শক্তিশালী করা গেলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা বিতরণের দুর্বলতা কমে আসবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. শাহ কামাল সমকালকে বলেন, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে সবসময়ই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এ বছর করোনাভাইরাসের কারণে অনেক কাজ সময়মতো করা সম্ভব হয়নি। টাকা ছাড় হয়নি সময়মতো। তবে এ কথা সত্য, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা দরকার। পাশাপাশি এসব কর্মসূচির মনিটরিং ও সুপারভিশন জোরদার করতে হবে।

সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, কর্মসংস্থান, দুর্যোগ মোকাবিলাসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তার বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। ২৫টি মন্ত্রণালয়ের শতাধিক কর্মসূচি রয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে সরকার ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে, যা মোট বাজেটের ১৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ আর জিডিপির ৩ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। সরকার বলছে, বর্তমানে দেশের ২৫ শতাংশ পরিবার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতাভুক্ত। সব মিলিয়ে এক কোটি সাত লাখ ২৬ হাজার মানুষকে সরাসরি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধার আওতাভুক্ত করেছে সরকার।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একই ধরনের পদ্ধতিতে এসব কর্মসূচির বাস্তবায়ন হয়ে থাকে। কর্মসূচি বাস্তবায়নে ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিয়ন সমাজকর্মী বা সোশ্যাল ওয়ার্কার (ইউএসডব্লিউ) ও উপজেলা পর্যায়ে একজন প্রোগ্রাম অফিসার কাজ করেন। সমাজকর্মীদের যখন নিয়োগ করা হয় তখন তার কাজের ব্যাপ্তি বা ধরন স্পষ্ট করা থাকে না। পর্যায়ক্রমে তিনি স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে বাস্তবায়িত বিভিন্ন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হন। ফলে তিনি বুঝতে পারেন না, কোন কাজটি কীভাবে করবেন। অন্যদিকে এই পর্যায়ের কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ বা ব্যবস্থাও তেমন নেই। ছয় বছর বা তার চেয়ে বেশি সময়ে তারা মাত্র একটি প্রশিক্ষণে অংশ নেন।

জরিপে দেখা গেছে, যোগাযোগের আধুনিক ব্যবস্থা এসব কর্মীরা ব্যবহার করছেন না। সব কর্মীর মোবাইল ফোন রয়েছে, যাদের মধ্যে ৪০ ভাগ স্মার্ট ফোন। তাদের ২৫ শতাংশ মোবাইলে খুদেবার্তা পাঠান না, আর ৩৩ শতাংশ যেসব খুদেবার্তা আসে তা পড়েন না। যদিও কিছু শিক্ষিত কর্মী কম্পিউটার ব্যবহার করেন এবং খুদেবার্তা পড়ে দেখেন। এদিকে গ্রামীণ দরিদ্রদের মাঝে বিনা সুদে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণের মতো কর্মসূচি ইউএসডব্লিউদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করে। প্রায় ৯০ ভাগ কর্মী এ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত। ঋণ দেওয়া, কিস্তি আদায় ইত্যাদি কাজে তারা আটকে থাকেন। এসব কর্মসূচির প্রচারণা, আবেদন পদ্ধতি, নির্বাচন প্রক্রিয়া, সুবিধা বাড়ানো, অভিযোগ প্রক্রিয়া আরও সহজ করার পরামর্শ এসেছে জরিপ প্রতিবেদনে।

এই জরিপের সময় বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে নাগরিকদের মতামতও নেওয়া হয়েছে। তারা বলেছেন, সরকার সামাজিক নিরাপত্তায় যেসব কর্মসূচি নিয়েছে সেগুলো ভালো। তবে বাস্তবায়ন আরও সুষ্ঠু হওয়া প্রয়োজন। অর্থায়ন ব্যবস্থাপনা আরও সুশৃঙ্খল হওয়া দরকার। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, সামাজিক অন্তর্ভুক্তির জন্য এই কার্যক্রমে নাগরিকদের সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।