দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ব্যয়ে ভোলায় তিনটি গ্যাসকূপ খননের কাজ দেওয়া হচ্ছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রমকে। দুটি অনুসন্ধান ও একটি উন্নয়ন কূপ খননের জন্য গ্যাজপ্রমকে দেওয়া হচ্ছে ৬৩ দশমিক ৫৯ মিলিয়ন ডলার। প্রতিটি কূপ খননে গড়ে ব্যয় হচ্ছে ২১ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। সংশ্নিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, এর আগে বাংলাদেশে কোনো গ্যাস কূপ খননে এত ব্যয় হয়নি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের আওতায় সমঝোতার মাধ্যমে এই কাজ পাচ্ছে বিশ্বের অন্যতম বড় গ্যাস কোম্পানিটি। সূত্র জানিয়েছে, প্রস্তাবটি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় হয়ে খুব দ্রুত ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে যেতে পারে। কূপ তিনটি হলো টবগি-১, ইলিশা-১ ও ভোলা নর্থ-২।
সূত্র জানায়, গ্যাজপ্রম গত বছরের ২৫ মে ভোলার ওই তিন কূপ খননের জন্য ৬৫ দশমিক ৮৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দর প্রস্তাব করে। প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করার জন্য একটি কারিগরি উপকমিটি গঠন করা হয়। এই উপকমিটি কয়েক দফা আলাপ-আলোচনা ও দর কষাকষি শেষে ৬৩ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন ডলার দর চূড়ান্ত করে তা জ্বালানি বিভাগের প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণ কমিটির (পিপিসি) কাছে উপস্থাপন করে। গত ২৭ আগস্ট পিপিসির সভায় এই দাম অনুমোদন করা হয়। গত ৯ সেপ্টেম্বর সভার কার্যবিবরণী প্রকাশ করা হয়েছে।
জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, এই কূপ তিনটি খননে অতিরিক্ত ব্যয়ের যুক্তি হিসেবে সমাঝোতা সভাগুলোতে বলা হয়েছে, ভোলা ক্ষেত্রে গ্যাসের চাপ (রিজার্ভার প্রেশার) বেশি, ৪৫০০ থেকে ৫০০০ পিএসআই। ফলে সেখানে কূপ খনন করা ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া, এই কাজের জন্য গ্যাজপ্রমকে ড্রিলিং কন্ট্রাক্টসহ ছয়টি প্রকৌশল সেবা (ডিএসটি, সিমেন্টিং, মাড লগিং, ওয়ারলাইন লগিং, টেস্টিং অ্যান্ড কমপ্লিশন) বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করতে হবে। কভিড-১৯ জনিত পরিস্থিতির কারণে সমুদ্র ও আকাশপথে চলাচল স্বাভাবিক না থাকায় মালপত্র ও জনবল আনা-নেওয়ার ব্যয়ও বাড়বে।
বঞ্চিত হচ্ছে বাপেক্স :ভোলা একটি আবিস্কৃৃত গ্যাসক্ষেত্র। সূত্রমতে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্স এটি আবিস্কার করেছে। সেখানে একাধিক কূপও খনন করেছে দেশি এ প্রতিষ্ঠানটি। গ্যাজপ্রমকে এখন যে তিনটি কূপ খননের কাজ দেওয়া হচ্ছে সেগুলোও বাপেক্সের দেওয়া ভূতাত্ত্বিক কারিগরি নির্দেশনা (জিওলজিক্যাল টেকনিক্যাল অর্ডার বা জিটিও) অনুসরণ করে, বাপেক্সের নির্ধারণ করে দেওয়া স্থানেই (লোকেশন) কূপ খনন করবে গ্যাজপ্রম। বাপেক্স ওই এলাকায় দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ করায় কূপ খননের জন্য প্রয়োজনীয় সব তথ্যই তাদের কাছে রয়েছে। কূপ খননের জন্য রিগসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং জনবলও বাপেক্সের আছে। আর একেকটি কূপ খনন করতে বাপেক্সের ব্যয় হবে সর্বোচ্চ ১০ মিলিয়ন ডলার (রিগ ভাড়া, জনবলের পেছনে ব্যয়, থার্ড পার্টির সেবাগুলোর ব্যয় সব মিলিয়ে)। কিন্তু বেশি মূল্যে বাপেক্সের এসব কূপ খননের কাজ দেওয়া হচ্ছে গ্যাজপ্রমকে।
গ্যাজপ্রম কম ব্যয়ে কূপ খনন করেছিল :বাংলাদেশে উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তির (পিএসসি) অধীনে সিলেট অঞ্চলের তিনটি ব্লকে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি শেভরনের প্রতিটি কূপ খননে গড় ব্যয় হয় ১৭ মিলিয়ন ডলার। গ্যাজপ্রম এর আগে গত এক দশকে একাধিক চুক্তির আওতায় বাংলাদেশে মোট ১৭টি কূপ খনন করেছে। এর মধ্যে প্রথম ১০টির চুক্তিমূল্য ছিল প্রায় ১৯৩ দশমিক ৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ, প্রতিটি কূপে কোম্পানিটি নিয়েছিল ১৯ মিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। পরের কূপগুলোতে গ্যাজপ্রম খনন করেছে ১৬ দশমিক ৪৮ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু এবার প্রতি কূপে খরচ দেওয়া হচ্ছে ২০ মিলিয়নের বেশি।
নির্দেশনা লঙ্ঘন :সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে ভোলার তিন কূপ খনন প্রস্তাবের যে সারসংক্ষেপ জ্বালানি বিভাগ থেকে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছিল সেখানে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল, গ্যাজপ্রম 'হ্রাসকৃত মূল্যে' এই তিনটি কূপ খনন করবে। প্রধানমন্ত্রী সেই প্রস্তাব অনুমোদন করেন। কিন্তু এখন তিনটি কূপের যে চুক্তিমূল্য চূড়ান্ত করা হয়েছে তা বাংলাদেশে গ্যাস কূপ খননে সর্বোচ্চ মূল্যের রেকর্ড। ফলে এটা এক প্রকার নির্দেশনার লঙ্ঘন হিসেবে দেখছেন সংশ্নিষ্টরা।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্স এই কূপগুলো খননে সম্পূর্ণ সক্ষম। এই অবস্থায় কোনো যুক্তিতেই রেকর্ড পরিমাণ বেশি ব্যয়ে এই কাজ অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া যৌক্তিক নয়। এটা জাতীয় স্বার্থবিরোধী কাজ হবে।
অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, গ্যাজপ্রম আমাদের সহযোগিতা করতে পারে চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে। তাদের সহযোগিতা দরকার গভীর কূপ খননে, সমুদ্রবক্ষে অনুসন্ধানে। তার পরিবর্তে বাপেক্সের আবিস্কৃত ক্ষেত্র তাদের কাছে দেওয়ার কোনো মানে হয় না।
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সমকালকে বলেন, গ্যাজপ্রমের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু তারা এই দরের নিচে নামতে চাচ্ছে না। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে ভোলার উন্নয়ন যেহেতু গ্যাজপ্রম করছে, তাই কূপ খননের কাজও তাদের দেওয়া হচ্ছে। কারণ উচ্চচাপের কূপ খননের অভিজ্ঞতা গ্যাজপ্রমের রয়েছে।
ভোলায় প্রথম অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয় ১৯৯৪ সালে। এরপর আরও তিনটি কূপ খনন করা হয়েছে। ২০০৯ সালের ১১ মে থেকে ভোলার শাহবাজপুর ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু করে বাপেক্স। শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র থেকে বর্তমানে দৈনিক পাঁচ কোটি ঘনফুট গ্যাস তোলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে এই গ্যাসক্ষেত্রে দেড় ট্রিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাস রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য শুধু শাহবাজপুর নয়, পুরো ভোলাতেই গ্যাস পাওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। ভোলা বেঙ্গল বেসিনভুক্ত। সেখানে যে ভূ-কাঠামোয় গ্যাস পাওয়া গেছে, তার ভূতাত্ত্বিক নাম 'স্টেটিগ্রাফিক স্ট্রাকচার'। দেশের অন্য সব গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কৃত হয়েছে সুরমা বেসিনে।
শাহবাজপুর ক্ষেত্র থেকে বর্তমানে ভোলায় দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে (২২৫ ও ৩৫ মেগাওয়াট) গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া স্থানীয় শিল্প ও আবাসিক গ্রাহকদেরও গ্যাস দেওয়া হচ্ছে।