ভারত রপ্তানি বন্ধ করায় হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠেছে পেঁয়াজের বাজার। তবে বাজারে এর সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। চাষি ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানির জন্য ব্যবসায়ীরা এলসি খুলছেন। ফলে এই মসলা পণ্যের দাম বৃদ্ধিকে অযৌক্তিক ও অবাস্তব বলে মনে করছে সরকার। এ অবস্থায় জনগণ যাতে যৌক্তিক দামে কিনতে পারে, সে জন্য ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করার পাশাপাশি পেঁয়াজ নিয়ে যে কোনো ধরনের কারসাজি ও মজুদদারির বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। অবৈধ মজুদ রোধে গতকালই দেশের বিভিন্ন বাজারে অভিযানে নেমেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসন। আজ বুধবার সামগ্রিক পরিস্থিতি তুলে ধরতে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন। এ সংবাদ সম্মেলনে মজুদদারির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি ঘোষণা করবেন বাণিজ্যমন্ত্রী।
বাণিজ্যমন্ত্রী সমকালকে জানিয়েছেন, বাজারে পেঁয়াজের দাম স্বাভাবিক রাখতে টিসিবির মাধ্যমে বিক্রি বাড়ানো হবে। পাশাপাশি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া আমদানি খরচ কমাতে আমদানি শুল্ক্ক তুলে নেওয়ার জন্য মঙ্গলবার পুনরায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চীন, মিসর, তুরস্ক, হল্যান্ড, নিউজিল্যান্ডসহ পেঁয়াজ আমদানির সব উৎস থেকে যাতে ব্যবসায়ীরা আমদানি করতে পারেন, সে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, এ বছর করোনার কারণে অনেক অনুষ্ঠান হয়নি, হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ ছিল। ফলে পেঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। আমরা আশা করছি, বাজার স্বাভাবিক থাকবে। পাশাপাশি দেশের ভেতর কেউ যাতে কারসাজি করতে না পারে, সে জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, জেলা প্রশাসন- সব পর্যায় থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে, যাতে কেউ সুযোগ নিতে না পারে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, দেশে পেঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে।
পাশাপাশি প্রয়োজনীয় আমদানির জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে কয়েক হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির জন্য এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে আশা করা যায় দাম স্বাভাবিক হয়ে আসবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্যবসায়ীদের সব ধরনের সহযোগিতা করছে। আমদানি যাতে সহজ হয় সেজন্য ব্যাংক, বন্দর ও পরিবহন পর্যায়ে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হচ্ছে। তবে কোথাও কেউ কোনো ধরনের কারসাজি করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। সেজন্য রাজধানী ও জেলা পর্যায়ে ব্যাপক অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও জেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাবুল কুমার সাহা জানিয়েছেন, ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণে সারাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পাইকারি ও খুচরা বাজারে তদারকি কার্যক্রম চলছে। প্রয়োজনে এ কার্যক্রম আরও জোরদার করা হবে। দেশে পেঁয়াজ, আদা, আলু, চালসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ ও সরবরাহ রয়েছে। নায্যমূল্যে এসব কেনাবেচা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯-২০ মৌসুমে দেশে ২ লাখ ৩৭ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের চাষ হয়েছে। এসব জমিতে ২৫ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। উৎপাদিত পেঁয়াজের ২০ ভাগ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও পরিবহণ পর্যায়ে নষ্ট হয়। সেই হিসাবে সর্বশেষ মৌসুম থেকে বাজারে সরবরাহযোগ্য পেঁয়াজের পরিমাণ প্রায় ২০ লাখ টন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেশে বছরে ২৫ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু রমজান মাসে ৪ লাখ টন পেঁয়াজ লাগে। বাকি ১১ মাসে দরকার হয় ২১ লাখ টন। ফলে ৫ থেকে সাড়ে ৫ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা আমদানির মাধ্যমে মেটাতে হয়। ট্যারিফ কমিশন জানিয়েছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত ৪ লাখ ৩৬ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। ভোমরা স্থলবন্দরের রাজস্ব কর্মকর্তা মহসিন হোসেন সমকালকে জানিয়েছেন, গত ৬ থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই বন্দর দিয়ে ৫৩৩টি ট্রাকে ১২ হাজার ৪৩৭ টন পেঁয়াজ দেশে এসেছে। বেনাপোল বন্দর দিয়ে ১ থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬৮০ টন পেঁয়াজ এসেছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জেলার চাষি ও ব্যবসায়ীদের কাছে সাড়ে ৫ লাখ টন পেঁয়াজ মজুদ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে যত পেঁয়াজ আমদানি হয়, তার বেশিরভাগই আসে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে। ভারত পণ্যটির রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় দেশের ব্যবসায়ীরা পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছেন। ব্যবসায়ীরা যাতে এই সুযোগ নিতে না পারেন সেজন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, যৌক্তিক মূল্যে পেঁয়াজ সরবরাহ নিশ্চিত করতে সরকার সব কিছু করবে। ব্যবসায়ীদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। এলসি খোলা, এলসি মার্জিন বাড়ানো, ঋণের সুদহার কমানো, বন্দর থেকে দ্রুত খালাস এবং সহজে পরিবহনের ব্যবস্থা সরকার করবে। আবার কোনো পর্যায়ে কেউ কারসাজির চেষ্টা করলে কঠোরভাবে দমন করা হবে। এজন্য ইতোমধ্যে গোয়েন্দা সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও জেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পেঁয়াজের বড় মোকাম ও বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হয় এমন জেলার প্রশাসন ইতোমধ্যে মাঠে নেমেছে। গতকাল রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে অভিযান চালিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাজার মনিটরিং টিম ও জেলা প্রশাসন। এসব অভিযানে পেঁয়াজের খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের সতর্ক করা হয়েছে।
মার্চ ও এপ্রিল দেশে পেঁয়াজ উৎপাদনের মূল মৌসুম। এর আগে জানুয়ারি থেকেই মুড়িকাটা পেঁয়াজ বাজারে আসতে শুরু করে। মার্চ-এপ্রিলে যে পেঁয়াজ ওঠে, তা দিয়ে চলে বছরের বাকি সময়। এ বছর উৎপাদনের পর দেশে যে আবহাওয়া ছিল, তা পেঁয়াজ সংরক্ষণে অনুকূল। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, দেশের পেঁয়াজ চাষি ও ব্যবসায়ীদের কাছে কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ লাখ টন পেঁয়াজ রয়েছে। ফলে নভেম্বর ও ডিসেম্বরের আগে বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহে ঘাটতি হওয়ার কথা নয়। পাবনা ও ফরিদপুরের প্রধান পেঁয়াজ উৎপাদনকারী এলাকার চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই এলাকার একেকজন চাষি বাড়িতেই ৫০ থেকে ৫০০ মণ পর্যন্ত পেঁয়াজ সংরক্ষণ করে থাকেন। কোনো কোনো বড় চাষি বা চাষের পাশাপাশি ব্যবসায় সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা এক হাজার মণ পেঁয়াজও সংরক্ষণ করেন।
অভিযান ও জরিমানা :এক দিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় গতকালই দেশের বিভিন্ন জেলার বাজারে অভিযান চালায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসন। ভোক্তা অধিদপ্তর জানিয়েছে, গতকাল সারাদেশে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও তাদের ৫০টি টিম ৯৮টি বাজারে অভিযান চালায়। এতে ১৫২টি প্রতিষ্ঠানকে পেঁয়াজের অতিরিক্ত দাম রাখাসহ অন্যান্য পণ্য বিক্রিতে অনিয়মের অভিযোগে ৮ লাখ ৭২ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। বেশি দামে বিক্রি করার অভিযোগে ঠাকুরগাঁওয়ের গোবিন্দনগর সমবায় মার্কেটের আল আমিন ট্রেডার্সকে এক লাখ টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল্লাহ আল মামুন। গাইবান্ধা সদর ও সাদুল্যাপুর উপজেলার ছয় ব্যবসায়ীকে ২৮ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভোক্তা অধিদপ্তর সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আবদুস ছালাম। ময়মনসিংহ শহরের মেছুয়া বাজারে অভিযান চালিয়ে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাঈদুল ইসলাম। যশোরের শার্শা উপজেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পুলক কুমার মণ্ডল গতকাল বেনাপোল বাজারে অভিযান চালিয়ে তিন প্রতিষ্ঠানকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। কুমিল্লা শহরের চকবাজারে অভিযান চালিয়ে পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে ৩২ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আছাদুল ইসলাম।
অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি :ভারত রপ্তানি বন্ধের আগেই বিকল্প দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির প্রক্রিয়া শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং থেকে গত দু'দিনে ১০০টির বেশি প্রতিষ্ঠান পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন নিয়েছে। এর আগে এই অফিস থেকে আমদানির অনুমোদন নিয়ে গত জুলাই ও আগস্ট মাসে ৯৬ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি করেছেন ব্যবসায়ীরা। এ অফিসের অতিরিক্ত পরিচালক (আমদানি-রপ্তানি পরীক্ষাগার) মো. ফজলুল হক সমকালকে জানান, প্রচুর প্রতিষ্ঠান পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদনের জন্য আবেদন করছে। অনুমোদনও দেওয়া হচ্ছে। চীন, পাকিস্তান, মিসর, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এসব প্রতিষ্ঠান পেঁয়াজ আমদানি করবে। এদিকে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, গত ৩ সেপ্টেম্বর থেকে গতকাল মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত বিশ্বের পাঁচটি দেশ থেকে ১০ হাজার ৯১ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি নিয়েছে ২৪টি প্রতিষ্ঠান। এই পাঁচটি দেশ হলো চীন, মিয়ানমার, পাকিস্তান, মিসর ও তুরস্ক। এর বাইরে চট্টগ্রামের ট্রেড ইমপ্যাক্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান ঢাকার উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্র থেকে ২ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি নিয়েছে। সব মিলিয়ে এ মাসের শেষ থেকে ১২ হাজার টন পেঁয়াজ দেশে আসতে শুরু করবে। চট্টগ্রামের বকশিরহাটের ট্রেডলিংক নামক প্রতিষ্ঠান মিসর থেকে এক হাজার টন, খাতুনগঞ্জ ট্রেডিং মিয়ানমার থেকে ৫০০ টন, আবুল বাশার অ্যান্ড সন্স ৫০০ টন ও জিয়াউর রহমান পাকিস্তান থেকে ৫০০ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি নিয়েছে।
খোলা বাজারে টিসিবির বিক্রি :পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকায় রাষ্ট্রীয় সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) গত ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করেছে। রাজধানীসহ সারাদেশে ২৭৬টি পয়েন্টে ট্রাকে করে ৩০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি করছে টিসিবি। হঠাৎ পণ্যটির দাম বেড়ে যাওয়ায় টিসিবির ট্রাক থেকে পেঁয়াজ কিনতে ভিড় বেড়েছে। একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ ২ কেজি কেনার সুযোগ পাচ্ছেন। বাজারের চেয়ে তিন ভাগের এক ভাগ দামে পেঁয়াজ পেয়ে দীর্ঘ সময় লাইনে থেকেও ক্রেতারা খুশি। তবে সব ক্রেতা পেঁয়াজ পাননি।









বিষয় : মজুদদাররা সাবধান

মন্তব্য করুন