আলু আমদানির নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কৃষকের ওপর
সাক্ষাৎকার

মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু ,সভাপতি, বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন
সমকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৩ | ১৮:২৫ | আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০২৩ | ০০:২৫
সমকাল: আলুর দাম বাড়ার পেছনে মূল কারণ কী?
মোস্তফা আজাদ চৌধুরী: দাম ধাপে ধাপে বেড়েছে। অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় সরকার দর নির্ধারণ করে দিয়েছে। তবে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে এসব পদক্ষেপ খুব বেশি কার্যকর হয় না। দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মজুত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলে দর এত বাড়ত না।
তাছাড়া সরবরাহ ব্যবস্থার কোথায় সমস্যা হচ্ছে, তা চিহ্নিত করে সমাধান করলে বাজার স্বাভাবিক থাকত। এখন দোষারোপ করে, চাপ সৃষ্টি করে চলমান সংকটের সমাধান হবে না।
সমকাল: আলু আমদানি হওয়ায় উৎপাদনে এর কোনো প্রভাব পড়বে কি?
মোস্তফা আজাদ চৌধুরী: আমদানির কারণে কিছু সময়ের জন্য দাম কমবে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে উৎপাদনে। আগামী মৌসুমে লোকসানের ভয়ে মজুতদার ব্যবসায়ীরা কৃষকের কাছ থেকে আলু কেনা কমিয়ে দেবেন। এতে কৃষক আলুর দর হারাবেন। উৎপাদন বিমুখ হবেন। ফলে অন্য ফসল উৎপাদনে ঝুঁকবেন। নভেম্বরের পর আলু আমদানি করা কোনোভাবেই ঠিক হবে না। কারণ ডিসেম্বরের শুরুতে পুরোদমে আলু উঠতে শুরু করবে। তাছাড়া কীভাবে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব, মজুত পরিস্থিতি কেমন, চাহিদা কত, দাম বাড়ছে কেন, সেসব বিষয়ে তথ্য উদঘাটন করা দরকার। তাহলে সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হবে।
সমকাল: উৎপাদনের পরিমাণ নিয়ে বিভ্রান্তি কেন? এতে কী ধরনের সমস্যা তৈরি হয়?
মোস্তফা আজাদ চৌধুরী: কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, ১ কোটি ৪ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ পরিমাণ উৎপাদন হয়নি। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বলছে, হিমাগারে ২৫ লাখ টন আছে। এ হিসাবে হিমাগারের বাইরে ৭৯ লাখ টন আলু থাকার কথা। মাসে ৭ লাখ টন ব্যবহার হলে ৫ মাসে (জানুয়ারি–মে) আলু ব্যবহার হয়েছে ৩৫ লাখ টন। ৩২ হাজার টন রপ্তানি হয়েছে। তারপরও সংস্থা দুটির হিসাবে ৪৩ লাখ টন আলু কৃষকের কাছে থাকার কথা। কিন্তু প্রকৃত চিত্র ভিন্ন। সাধারণত জুলাইর শুরু থেকে আলু বের হতে শুরু করে হিমাগার থেকে। এ বছর মে মাসের ২০ তারিখ থেকে হিমাগার থেকে আলু বিক্রি শুরু হয়। দেড় মাস আগেই হিমাগার থেকে বিক্রি শুরু হয়। এর মানে উৎপাদন এবং সংরক্ষণের তথ্যে গরমিল রয়েছে। ভুল তথ্যের কারণে চাহিদার সঙ্গে উৎপাদনের ফারাক তৈরি হয়েছে। দেশে বেসরকারি খাতে ৪০০টির বেশি হিমাগার রয়েছে। এর মধ্যে ১৮১টি বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য। হিমাগারগুলোর তথ্যমতে, এ বছর ২৩ লাখ ১২ হাজার টন আলু হিমাগারে রাখা হয়েছে। গত বছরে ছিল ২৪ লাখ ২০ হাজার। অর্থাৎ এবার ১ লাখ ৭ হাজার টন কম এসেছে। সেজন্য হিমাগারে ২০ শতাংশ জায়গা খালি ছিল।
সমকাল: হিমাগার পর্যায়ে সরকার নির্ধারিত দরে বিক্রি না হওয়ার কারণ কী?
মোস্তফা আজাদ চৌধুরী: নির্দিষ্ট সময়ের আগেই হিমাগার থেকে আলু বের হওয়ার কারণে ফড়িয়া, ব্যবসায়ী, কৃষক কিংবা হিমাগার মালিক সবাই বুঝতে পেরেছেন, আলুর সংকট রয়েছে। সেজন্য সবাই আলু ছেড়েছেন সীমিত আকারে। ফলে দাম বেড়ে যায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত ১৪ সেপ্টেম্বর হিমাগার পর্যায়ে আলুর দর ২৬ থেকে ২৭ টাকা বেঁধে দেয়। কিন্তু সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। কারণ মুক্তবাজার অর্থনীতিতে দাম বেঁধে দিলে তা বাস্তবায়ন হয় না। তবে কিছু মুনাফালোভী মজুতদার নামে-বেনামে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না।
সমকাল: আলুর বর্তমান বাজার পরিস্থিতি নিয়ে প্রান্তিক কৃষকরা কী বলছেন?
মোস্তফা আজাদ চৌধুরী: ২০১৩ ও ২০১৪ এবং ২০১৭ থেকে ২০২১ সালে প্রতি বছর গড়ে এক কোটি টনের বেশি আলু উৎপাদন হয়েছে। চাহিদা কম থাকায় ওই বছরগুলোতে ১৫ থেকে ২০ লাখ টন আলু উদ্বৃত্ত ছিল। ২০১৩ সালে ৮০ কেজির আলুর বস্তা বিক্রি হয় ১০০ টাকায়। অনেকেই আলু ফেলে দিয়েছেন। প্রায় একই পরিস্থিতি হয় ২০১৪ ও ২০১৭ সালে। এতে অনেকেই পুঁজি হারিয়ে ঋণখেলাপি হন। এখন আলুর দর বেড়েছে। এতে কিছুটা লাভের মুখ দেখছেন। তাই তারা আমদানির বিপক্ষে।
সমকাল: বাজার নিয়ন্ত্রণে আপনার পরামর্শ কী?
মোস্তফা আজাদ চৌধুরী: যে বছর উৎপাদন কম হবে, সেই বছর সরকার কৃষক থেকে আলু কিনে কম ভাড়ায় হিমাগারে রেখে সংকটের সময় কেনা দামে খোলাবাজারে বিক্রি করতে পারে। এতে সারা বছর দাম স্থিতিশীল থাকবে। আবার উৎপাদন বেশি হলে কৃষকদের স্বার্থ রক্ষায় উদ্বৃত্ত আলু সরকারের ত্রাণকার্য, কাবিখা, ওএমএস, ভিজিডি, জেলখানায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীদের মধ্যে বিতরণ করা যাবে। উৎপাদন বাড়াতে উন্নত জাতের বীজ ও সার ভর্তুকি দেওয়া দরকার। তা ছাড়া মৌসুমের শুরুতে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন দর বেঁধে দিলে আলুর বাজারে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে না।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জসিম উদ্দিন বাদল